হুয়াওয়ে কি যুক্তরাষ্ট্রকে হারিয়ে দিল?
হুয়াওয়ে চীনা প্রতিষ্ঠান। আর চীন হল যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শত্রু। সে হিসেবে হুয়াওয়েও তাদের শত্রু। যদিও হুয়াওয়ে একটা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, তবু এর বিরুদ্ধে আমেরিকা উঠেপড়ে লেগেছিল। নানাভাবে ধসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। হয়ত আমেরিকান প্রযুক্তিশিল্পকে এগিয়ে রাখতে তারা এটা করেছিল। তাদের অজুহাত ছিল, হুয়াওয়ে চীনের পক্ষে গোয়েন্দাগিরি করছে, যা আমেরিকার জন্য হুমকি।
সেই হুয়াওয়ে সম্পর্কে সম্প্রতি সংবাদ প্রতিষ্ঠান সিএনএনের এক প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে, ‘হুয়াওয়ে প্রযুক্তিশিল্পের ইতিহাসে সবচেয়ে চমকপ্রদভাবে প্রত্যাবর্তন করেছে।’ ‘ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে ক্রমবর্ধমান প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে হুয়াওয়ে একটি ফ্ল্যাশপয়েন্ট হয়েছে, ৯০ কোটির বেশি স্মার্টফোন এখন হুয়াওয়ের অপারেটিং সিস্টেম (হারমনি ওএস) ব্যবহার করছে।’
হুয়াওয়ের কনজিউমার বিজনেস গ্রুপের চেয়ারম্যান রিচার্ড ইউ বলছেন, ‘আমাদের ইউরোপীয় এবং আমেরিকান সমকক্ষরা ৩০ বছর ধরে যা করেছেন তা আমরা ১০ বছরে করেছি এবং অপারেটিং সিস্টেমের মূল প্রযুক্তিতে স্বাধীনতা অর্জন করেছি।’
হারমনি, যাকে চীনা ভাষায় ‘হংমেং’ বলা হয়, ২০১৯ সালে প্রথম উন্মোচন করা হয়েছিল। এর পরপরই হুয়াওয়েকে মার্কিন বাণিজ্যে কালোতালিকায় রাখা হয়েছিল। আমেরিকান সংস্থাগুলিকে লাইসেন্স ছাড়া হুয়াওয়ের কাছে প্রযুক্তি ও সফ্টওয়্যার বিক্রি করতে বাধা দেওয়া হয়েছিল। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার উপায় ছিল না। সে সময় গুগলের এনড্রয়েড সফটওয়্যার ব্যবহার করত হুয়াওয়ে। এনড্রয়েড না পেয়ে বিপাকে পড়ে হুয়াওয়ে। অনেকেই ভবিষ্যদ্বাণী করেন, হুয়াওয়ের এখানেই ইতি।
মার্কিন নীতিনির্ধারকরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি করেছেন, হুয়াওয়ে তাদের জাতীয় নিরাপত্তায় ঝুঁকি তৈরি করেছে। হুয়াওয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করতে পারে। হুয়াওয়ে বারবার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে, কিন্তু আমেরিকাকে থামাতে পারেনি। এমনকি আমেরিকার মিত্র ইংল্যান্ডও হুয়াওয়ের ভূমিকা সীমিত করে; বাধা দেয় ৫জি নেটওয়ার্ক তৈরিতে।
কিন্ত হুয়াওয়ে বসে থাকেনি। নিজেরাই এনড্রয়েডের বিকল্প মোবাইল অপারেটিং সফটওয়্যার (হারমনি ওএস বা হংমেং) তৈরি করতে উঠেপড়ে লাগে।
এখন আবারও শীর্ষস্থানে ফিরে আসছে হুয়াওয়ে। তাছাড়া তারা নতুন ব্যবসায়ও উদ্যোগী হচ্ছে। গত বছর মার্কিন ধনকুবের ইলন মাস্কের বৈদ্যুতিক গাড়ি টেসলার মডেল এস-এর সাথে লড়াই করার জন্য একটি বৈদ্যুতিক সেডান চালু করেছে হুয়াওয়ে এবং সেখানে তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রয়োগ করেছে, যা তাদের বিরাট উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করছে।
আমেরিকান বহুজাতিক কর্পোরেশন ও প্রযুক্তি কোম্পানি এনভিডিয়া, বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান পাবলিক কোম্পানি, মাইক্রোসফটের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। এনভিডিয়া এ বছরের শুরুতে হুয়াওয়েকে কয়েকটি ক্ষেত্রে শীর্ষ প্রতিযোগী হিসেবে মনোনীত করেছে। কয়েকটি ক্ষেত্রের মধ্যে একটি হল প্রসেসর, যার বাণিজ্য সারা দুনিয়ায় নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র কয়েকটা প্রতিষ্ঠান।
রিচার্ড ইউ শুক্রবার এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, হুয়াওয়ের নিজস্ব এআই ফ্রেমওয়ার্ক, যা অ্যাসেন্ড প্রসেসরের সমন্বয়ে গঠিত, মূলধারার আন্তর্জাতিক এআই-এর তুলনায় ১.১ গুণ বেশি কার্যকর। অ্যাসেন্ড প্রসেসর হুয়াওয়ের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান।
হুয়াওয়েকে পুনরুজ্জীবন দিয়েছে মূলত এর স্মার্টফোন। হুয়াওয়ের ফ্ল্যাগশিপ স্মার্টফোন বিক্রি ২০২৪ সালের প্রথম পাঁচ মাসে ৭২ শতাংশ বেড়েছে, এক বছর আগের একই সময়ের তুলনায়। রিচার্ড ইউ বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর বিধিনিষেধ সত্ত্বেও শীর্ষে ফিরে যাওয়ার জন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষার উপর সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছে হুয়াওয়ে।
তাদের জনপ্রিয় মেট৬০ প্রো-স্মার্টফোন গত বছর সব সংবাপত্রের শিরোনাম হয়েছিল। কারণ মার্কিন সরকার মডেলটি সম্পর্কে আরও তথ্য চেয়েছিল। এই মোবাইল ফোনে একটি অত্যাধুনিক প্রসেসর ব্যবহৃত হয়েছে, যা হুয়াওয়ের নিজস্ব।
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মেট৬০ প্রো-স্মার্টফোন প্রযুক্তিশিল্পের বিশেষজ্ঞদের হতবাক করেছিল। তারা প্রশ্ন করেছিলেন, মার্কিন প্রযুক্তি ছাড়াই হুয়াওয়ে চিপশিল্পে কোন উপায়ে সফলভাবে প্রবেশ করল?
হুয়াওয়ের নিট মুনাফা চলতি অর্থ বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে ৫৬৪ শতাংশ বেড়ে ২.৭১ বিলিয়ন ডলার হয়েছে, যা গত চার বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। কাউন্টারপয়েন্ট রিসার্চের তথ্য অনুসারে, হুয়াওয়ের অভিঘাতে অ্যাপলের ভিত কেঁপে উঠেছে।
আমেরিকান প্রতিষ্ঠান অ্যাপলের আইফোন সারা দুনিয়ায় বিশেষ সমাদৃত।
কাউন্টারপয়েন্টের তথ্যানুযায়ী, গত বছর অ্যাপল চীনের স্মার্টফোন বাজারের ২০ শতাংশ দখল করে নেতৃত্বস্থানে ছিল। এ বছর প্রথম ত্রৈমাসিকে তারা তৃতীয় স্থানে নেমে গেছে। এর মার্কেট শেয়ার ১৫.৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে হুয়াওয়ের শেয়ার ২০২৩ সালে যেখানে ছিল ৯.৩ শতাংশ, সেখান থেকে এবার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫.৫ শতাংশে।