হোম পিছনে ফিরে যান

নেতাদের ভুলে নেত্রীর সন্ধানে একটি দল

uttarbangasambad.com 2024/10/6

রন্তিদেব সেনগুপ্ত

এবারের লোকসভা ভোটে আসন কমে যাওয়ার পর, বিজেপির উপলব্ধি হয়েছে, নেতাদের ওপর ভরসা করে কোনও লাভ নেই। এবার নেত্রী খুঁজতে বাজারে নামতে হবে। যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। দিল্লির বিজেপি নেতারা এবার বাংলায় তাঁদের দলের নেত্রী খুঁজতে নেমেছেন। আর বাংলায় দলের নেত্রীরাও এই মওকায় পদ লাভের ইঁদুর দৌড়ে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন। অবশ্য শিকে কতখানি তাঁদের ভাগ্যে শেষপর্যন্ত ছিঁড়বে সে নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।

হঠাৎ নেতা ছেড়ে নেত্রীর খোঁজে কেন বিজেপি? এ নিয়ে বিজেপির এক নেতার সঙ্গে কথা হচ্ছিল সম্প্রতি। বিজেপির সর্বোচ্চ পদটিতে, সে রাজ্যে হোক বা দিল্লিতে, আজ পর্যন্ত কোনও মহিলা বসেননি। বলা ভালো, ওই পদটিতে কোনও মহিলাকে বসানোর কথা চিন্তা করেনি বিজেপি নেতৃত্ব। বিজেপি-আরএসএসের মতো পুরুষতান্ত্রিক মনুবাদী সংগঠনের পক্ষে দলের সর্বোচ্চ পদে কোনও মহিলাকে বসানোর চিন্তা করাও কঠিন। সে কারণেই সমস্ত রকম যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সুষমা স্বরাজ কোনওদিন দলীয় সংগঠনের শীর্ষপদটি পাননি। তাহলে হঠাৎ, এই রাজ্যের ক্ষেত্রে এরকম ব্যতিক্রমী ভাবনা কেন বিজেপি নেতৃত্বের?

বিজেপি নেতাটি বলছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলটি বিজেপির পক্ষে অতীব জরুরি। এবং সেই লক্ষ্যে বিজেপি সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য যে কোনও রকম কৌশল অবলম্বন করতেও বিজেপি পিছপা নয়। সেক্ষেত্রে যদি পুরুষতান্ত্রিক সংগঠনের শীর্ষে আপাতত কোনও মহিলাকে মেনে নিতে হয়- তাতেও নয়।

পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলে বিজেপি-আরএসএস যে বড়ই উদ্গ্রীব, সেটি বুঝতে পেরেছিলাম কয়েক বছর আগে আরএসএসের সরসংঘচালক মোহন ভাগবতের সঙ্গে ঘরোয়া অনুষ্ঠানে কথা বলার সময়। ভাগবত বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে যেদিন বিজেপি সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ক্ষমতা দখল করতে পারবে, সেইদিন সারা ভারতেও নিরঙ্কুশভাবে ক্ষমতায় আসবে বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গের যে একটি আলাদা রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে বিজেপি-আরএসএসের কাছে, সেটি ভাগবত সেদিন বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।

পশ্চিমবঙ্গ দখলের জন্য নানাবিধ কৌশল বিজেপি কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরেই করে চলেছে। কিন্তু বিজেপির দুর্ভাগ্য, তাদের কোনও কৌশলই আজ পর্যন্ত সেভাবে সফল হয়নি। এমনকি, এবারের লোকসভা ভোটেও সন্দেশখালি, দুর্নীতি, মতুয়া, হিন্দু-মুসলমান ইত্যাদি নানাবিধ কার্ড খেলার পরও এই রাজ্যে বিজেপির রাজনৈতিক গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী হয়নি। বরং তা আরও নীচের দিকে নেমেছে।

এত কৌশল খাটিয়েও এখানে তৃণমূলকে কাবু করতে পারছে না কেন বিজেপি? তার কারণ, তৃণমূলে একজন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আছেন। বিজেপিতে নেই। আমি বিজেপি এবং আরএসএসের বহু শীর্ষস্থানীয় নেতার সঙ্গে একান্তে কথা বলে দেখেছি, তাঁরাও মনে করেন, এই রাজ্যে শুধু নয়, জাতীয় স্তরেও মমতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নেত্রী। তাঁকে টক্কর দেওয়া খুব সহজ নয়। এমনকি মমতার এই গুরুত্বকে আরএসএসের সরসংঘচালক ভাগবতও অস্বীকার করেন না।

লোকসভা ভোটের ফল পর্যালোচনা করে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা বুঝেছেন, এই রাজ্যের মহিলা ভোটারদের গরিষ্ঠাংশ ভোট তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে গিয়েছে। তার একটি বড় কারণ যেমন রাজ্য সরকারের চালু করা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বা কন্যাশ্রীর মতো সামাজিক প্রকল্প, তেমনই মহিলা ভোটারদের ভিতর ব্যক্তি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রভাব। মমতাকে উদ্দেশ্য করে কিছু নেতার অশালীন কটু মন্তব্য মহিলা ভোটাররা ভালোভাবে নেননি- এটিও দলীয় নেতৃত্বের পর্যালোচনায় ধরা পড়েছে।

এরই পাশাপাশি দলের নেতৃত্বের ভার যাঁদের ওপর দেওয়া হয়েছিল, মূলত শুভেন্দু অধিকারী এবং সুকান্ত মজুমদার, তাঁদের ভূমিকায় দিল্লির নেতৃত্ব সম্পূর্ণ হতাশ। ২০২১ এবং ২০২৪-এর দুটি নির্বাচন দেখার পর বিজেপি নেতৃত্ব মনে করছেন, শুভেন্দু পূর্ব মেদিনীপুরের নেতা ব্যতীত আর কিছুই নন। তদুপরি দলীয় সংগঠনকে মজবুত করার থেকেও নিজের গোষ্ঠী তৈরি করায় শুভেন্দুর আগ্রহ বেশি। আরএসএসও মনে করছে, লোকসভা ভোটে প্রার্থী নির্বাচনে শুভেন্দুকে ঢালাও ছাড়পত্র দেওয়া ভুলই হয়েছে। নিছক গোষ্ঠী রাজনীতির কারণে এতাবৎকালের বিজেপির সবথেকে সফল রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের কেন্দ্র বদলে দেওয়া, নিজের মনমতো প্রার্থী বাছাই করে বিজেপির বিপর্যয় ডেকে এনেছেন শুভেন্দু- রাজ্য বিজেপির বড় অংশই মনে করছেন এরকম। এরই পাশাপাশি সুকান্ত মজুমদার। বিজেপির অনেক নেতা বলছিলেন, দলের ভিতরে সুকান্তর পরিচয় এখন ‘বিবৃতি সভাপতি’। বস্তুত, বিবৃতি দেওয়া ছাড়া দলীয় সংগঠনকে শক্তিশালীই করতে পারেননি সুকান্ত। উত্তরবঙ্গে বিজেপির সংগঠন শক্তিশালী হয়েছে মূলত আরএসএসের প্রচেষ্টায়। বিজেপি নেতৃত্বের পর্যালোচনায় ধরা পড়েছে, দক্ষিণবঙ্গে সত্তর শতাংশ বুথ কমিটিই গড়তে পারেনি বিজেপি।

এমতাবস্থায় বিজেপি নেতৃত্ব বুঝতে পারছে, ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচন শুভেন্দু-সুকান্তকে মাথায় রেখে সম্ভব নয়। এমনিতেই অবশ্য সুকান্ত কেন্দ্রে মন্ত্রী হয়ে যাওয়ার পর তাঁকে সভাপতির পদটি কিছুদিনের ভিতরেই ছাড়তে হবে। এই অবস্থায় দলের ভিতরে এমন একটি কথা উঠেছে যে, মমতাকে মোকাবিলা করার জন্য এই রাজ্যে কোনও মহিলা নেত্রীকে সংগঠনের শীর্ষে বসানো যায় কি না। সেক্ষেত্রে তিন-চারজন নেত্রীর নাম নেতৃত্বের ভাবনায় রয়েছে। এঁরা হলেন লকেট চট্টোপাধ্যায়, অগ্নিমিত্রা পল এবং মালতী রাভা রায়। এঁদের ভিতর ধারে এবং ভারে লকেট অনেকটা এগিয়ে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গেও লকেটের সুসম্পর্ক রয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মহিলা মুখের খোঁজে রয়েছেন, এটা জানার পর এই নেত্রীরাও সক্রিয় হয়ে উঠেছেন।

তবে এক্ষেত্রেও দলীয় নেতৃত্বের ইতস্তত ভাব রয়েছে। দলীয় নেতৃত্ব মনে করছে, এঁরা মহিলা নেত্রী হলেও মমতাকে মোকাবিলা করার মতো ধার এবং ভার এঁদের কারও নেই। মমতার মতো দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম করে উঠে আসার ইতিহাসও এঁদের নেই। এঁদের দিয়ে আদৌ মমতার মোকাবিলা সম্ভব কি না সে নিয়েও দোলাচলে রয়েছে বিজেপি নেতৃত্ব।

সমস্যা আরও রয়েছে। শুভেন্দু-সুকান্তকে কাদায় পড়তে দেখে দিলীপ ঘোষের মতো অনেকেই ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছেন। দিলীপ তো রীতিমতো জেলা সফর শুরু করেছেন। সংবাদমাধ্যমের সামনে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন। লক্ষ্য একটাই, সভাপতি পদ। শুধু দিলীপ নন, আরও কয়েকজনও এই পদের দাবিদার হয়ে দিল্লিতে যোগাযোগ শুরু করেছেন। শুভেন্দুও যে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবেন, মনে হয় না। বিজেপি নেতৃত্ব মহিলা মুখ বেছে নিতে সক্রিয় হলে এই নেতারাই তখন নেত্রী ঠেকাতে প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়বেন। অতএব, বিজেপির পক্ষে নেতাদের উপেক্ষা করে নেত্রী বেছে নেওয়াটা সহজ হবে না।

শেষপর্যন্ত মমতার বিপরীতে কোনও মহিলা মুখ বিজেপি নেতৃত্ব বেছে নিতে পারবে, নাকি, লকেট-অগ্নিমিত্রা-মালতীদের আবার দিলীপ-শুভেন্দু-সুকান্তদের পিছনের সারিতে দাঁড়াতে হবে- আপাতত এ নিয়েই বিজেপির অন্দরমহল সরগরম।

People are also reading