হোম পিছনে ফিরে যান

শ্রীপুরে কাঁঠালের ফলন ভালো, পৃষ্ঠপোষকতা চান বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা

rtvonline.com 2024/7/4

জাতীয় ফল হিসেবে সবার কাছে সমাদৃত কাঁঠাল। এটি শুধু পুষ্টিগুণে ভরপুর ফলই নয়, অর্থকরী ফল হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ। আবার কাঁঠাল কাঠের তৈরি আসবাবের কদর দেশজুড়ে। কাঁঠাল সুমিষ্ট গ্রীষ্মকালীন ফল হিসেবে পরিচিত। গাজীপুরের শ্রীপুরের কাঁঠালের সুখ্যাতি রয়েছে দেশজুড়ে। মাটির গুণে শ্রীপুরের কাঁঠালের ফলন ও স্বাদ বেশি। পাকা কাঁঠালের গন্ধে এখানকার শ্রীপুর উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন এবং পৌরসভার প্রতিটি গ্রাম। শ্রীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাথে কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাত এবং রপ্তানিকরণ নিয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ শুরু করেছে।

স্বাদে-ঘ্রাণে মিষ্টি কাঁঠাল খুব সস্তায় বিক্রি করা হয়। শ্রীপুরে নোয়াখালী এবং সিলেট থেকে পাইকাররা এসে কিনে দেশের বিভিন্ন বাজারে নিয়ে বিক্রি করছে। কিন্তু সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় ন্যায্যমূল্য পান না বাগান মালিকেরা। অনেক সময় আবার পচে নষ্ট হয়ে যায় কাঁঠাল।

বাগান মালিক, পাইকার ও খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, কাঁঠালের দাম পড়ে যাওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের। তাদের অভিযোগ, কাঁঠাল সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। তবে সরকারি-বেসরকারি কোনো পর্যায়ে প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যবস্থা না থাকায় বাগান মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ ছাড়া দীর্ঘদিনেও সরকার বিদেশে কাঁঠালের বাজার সৃষ্টি করতে না পারায় সম্ভাবনাময় এই খাত থেকে আশানুরূপ ফল আসছে না। শ্রীপুরের বাগান মালিকেরা এ ফল নিয়ে চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

উপজেলার তেলিহাটি, কাওরাইদ, বরমী, রাজাবাড়ী, গোসিংঙ্গা, মাওনাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গাছগুলো ভরে গেছে ফলে ফলে। এসব বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ভ্যানে করে কাঁঠাল আনা হয়েছে। আড়ত মালিকেরা ছোট-বড় কাঁঠালগুলো আলাদা করে বিভিন্ন দামে কিনছেন।

প্রতিটি গাছে ৫০ থেকে ১০০ পর্যন্ত কাঁঠাল ধরেছে। তবে শ্রীপুর শিল্প অধ্যুষিত হওয়ায় যেসব এলাকা কারখানা গড়ে উঠছে সেসব এলাকা থেকে দিনদিন বিলুপ্ত হচ্ছে কাঁঠাল গাছ। তাই বাগানের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। শিল্প কারখানা গড়ে ওঠায় অনেকেই কাঁঠাল গাছ বিক্রি দিচ্ছেন। আসবাব প্রস্তুতকারী ও ব্যবসায়ীরা নামমাত্র দাম দিয়ে কিনে ফায়দা লুটছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

শ্রীপুরের সবচেয়ে বড় কাঁঠালের হাট তেলিহাটি ইউনিয়নের জৈনা বাজার। এ মৌসুমে কাঁঠাল বিক্রি হচ্ছে পানির দরে। ১৫ কেজির ওপরে বড় সাইজের একটি কাঁঠাল বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। আর মাঝারি সাইজের কাঁঠাল বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১৫-২০ টাকায়। ফলে দাম না পাওয়ায় এলাকার অনেকে কাঁঠাল তাদেও বাড়িতে গরু-ছাগলের খাবার হিসেবে খাওয়াচ্ছেন। বাজারে ইজারা পরিমাণ বেশি হওয়ায় ব্যবসায়ী ও ক্রেতা কাঁঠাল কিনতে চাচ্ছে না। এ কারণে কাঁঠালের দাম নেমে গিয়েছে।

কেওয়া গ্রামের কাঁঠাল বাগান মালিক আলমাছ উদ্দিন জানান, একসময় কাঁঠালের অনেক কদর ছিল। শ্রমিকদের মজুরি হিসেবে কাঁঠাল দেওয়া হতো। ৩/৫টি কাঁঠালের বিনিময়ে একজন শ্রমিক তার গৃহস্থের সারা দিন কাজ করে দিতেন। বর্তমান সমেয় কৃষকেরা তাদের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাত ব্যবস্থা গড়ে তুললে এ উপজেলার মানুষ অর্থনৈতিকভাবে আরও উপকৃত হবে।

কাঁঠাল ব্যবসায়ী আবুল হোসেন জানান, প্রায় মাস খানেক আগে থেকে বাজারগুলোতে পাকা কাঁঠাল উঠতে শুরু করেছে। দুই থেকে তিন মাস কাঁঠালের ভরা মৌসুম থাকে। এ সময় পাইকার ও শ্রমিক শ্রেণির লোকদের বাড়তি আয়ের সুযোগ হয়। এবার কাঁঠালের ফলন ভালো হয়েছে। জাতীয় ফল কাঁঠাল আকারে বড়, পুষ্টি সমৃদ্ধ ও গুনমান অনেক বেশি। কাঁঠালের কোন অংশই ফেলনা নয়। পাকা কাঁঠালের কোশ সুস্বাদু খাবার, বাকল গবাদি পশুর খাদ্য, বীজ ও কাঁচা কাঁঠাল তরকারি হিসেবে খাওয়া যায়।

মাওনা ইউনিয়নের বারতোপা গ্রামের বাগান মালিক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, কাঁঠাল গাছের খুব একটা যত্ন করি না। তবু এবার আমার বাগানের ৭০ থেকে ৮০টি গাছে প্রচুর কাঁঠাল ধরেছে। গত ১৫ দিনে ছোট-বড় ৫০০-৭০০ কাঁচা কাঁঠাল বিক্রি করেছি। এ রকম ২০০টি মাঝারি ও ছোট্ট আকারের প্রতি পিস কাঁঠাল ২৫ টাকায় বিক্রি করেছি। বড় আকারের কাঁঠালগুলো প্রতি পিস ৪০-৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কাঁঠালগুলো দ্রুত পেকে পচে যাওয়ার ভয়ে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছি।

কাওরাইদ এলাকার বাগান মালিক জুয়েল রানা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, অন্যান্য ফল ও গাছ নিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়, কাঁঠাল নিয়ে তার সিকি ভাগও হয় না। অথচ কাঁঠাল একটি অর্থকরী ফসল ও জাতীয় ফল। কোনো পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় ও অবাধে কাঁঠাল গাছ নিধন হওয়ায় উপজেলায় কাঁঠাল বাগানের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এখন বাড়ির আঙ্গিনা ও সড়কের ধারে ছাড়া তেমান বাগান চোখে পড়ে না। সরকার একটু নজর দিলে অনেকেই কাঁঠাল-বাগানে উদ্বুদ্ধ হতো।

জৈনা বাজারের আড়তদার সোহেল রানা বলেন, এবারের বন্যার কারণে সিলেটে কাঁঠাল কেনাবেচা কম। কাঁঠালের বাজার অর্ধেকে নেমে এসেছে। উপজেলায় সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যবস্থা থাকলে বাগান মালিকেরা ন্যায্য দাম পেতেন এবং ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই লাভবান হতেন। নতুন করে অনেকে বাণিজ্যিকভাবে কাঁঠাল চাষে আগ্রহী হতেন।

জৈনা বাজারের ইজারাদার আব্দুল হান্নান বলেন, প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জৈনা বাজার চলে কাঁঠাল বেচা-কেনা। এ হাট থেকে প্রতিদিন ৪০-৫০ ট্রাক কাঁঠাল দেশের বিভিন্ন এলাকায় যায়।

সিলেট থেকে আসা পাইকার রসুল মিয়া বলেন, শ্রীপুরের লাল মাটির উৎপাদিত কাঁঠালের স্বাদ অনেক ভালো। রসে টইটম্বুর মিষ্টি এসব কাঁঠালের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাই এখান থেকে প্রতি সপ্তাহে আট ট্রাকে কাঁঠাল নিয়ে বিক্রি করছি। ট্রাক দিয়ে কাঁঠাল নেওয়ার খরচসহ শ্রমিকদের খরচ বাদ দিলে খুব বেশি লাভ করা সম্ভব হয় না।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ইনজুর মেডিকেল অফিসার ও হৃদরোগ বিভাগের চিকিৎসক শ্রীপুরের বাসিন্দা ডা. মামুনুর রহমান কাঁঠালের গুণাগুণ ও পুষ্টিগুণ সম্বন্ধে বলেন, কাঁঠাল একটি পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ফল। কাঁঠালে কয়েক প্রকার ভিটামিন ও পুষ্টি রয়েছে। কাঁঠাল তরকারি হিসেবে খেলে আলাদা ভিটামিন পাওয়া যায়। কাঁঠালের বিচিতে পর্যাপ্ত পুষ্টি রয়েছে। তা ছাড়া কোনো প্রকার কীটনাশক ছাড়া প্রাকৃতিকভাবে কাঁঠাল হয়ে থাকে। মৌসুমি ফল অনুযায়ী যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই ভালো।

শ্রীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ সুমাইয়া সুলতানা বণ্যা বলেন, শ্রীপুরে বাণিজ্যিক ভিত্তিক কাঁঠাল-বাগান নেই। এ বছর উপজেলায় ২৮০০ হেক্টর জমিতে কাঁঠাল গাছ রয়েছে। এসব গাছে বছরে ৬০ হাজার টন কাঁঠাল উৎপাদন হয়। স্থানীয়ভাবে চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করেন বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা।

তিনি আরও জানান, হরটেক্স ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সঙ্গে কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাত এবং রপ্তানিকরণ নিয়ে কাজ শুরু করেছে। কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান, নারী উদ্যোক্তা গঠন, কাঁঠালের চিপস, বার্গার, আচার ঝুড়ি বাজা তৈরি করার জন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। এ বছর থেকে তারা এসব কার্যক্রম শুরু করেছে।

People are also reading