হোম পিছনে ফিরে যান

কোরবানির পশুর চামড়া ও অর্থনীতি

dailyjanakantha.com 3 দিন আগে

ড. মো. আইনুল ইসলাম

কোরবানির পশুর চামড়া ও অর্থনীতি
পশুর চামড়া ও অর্থনীতি

বছর দুয়েক আগে বাংলাদেশে ধর্ম নিয়ে ব্যবসা সম্পর্কিত একটি আবেদন দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদকে জমা দিয়েছিল জাতীয় গণতদন্ত কমিশন। ওই আবেদনে বলা হয়েছিল, যদি মানিলন্ডারিংয়ের মতো অপরাধ নিয়ে দুদকে আবেদন করা যায় তাহলে ধর্মকে উপলক্ষ করে এবং ধর্মীয় বক্তব্য দিয়ে ব্যবসা করার বিষয়টিও দুদক খতিয়ে দেখতে পারে। কিছুটা জটিল ও স্পর্শকাতর হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে পরে আর তেমন কিছু শোনা যায়নি।

ধর্ম নিয়ে ব্যবসা কিংবা ধর্ম দিয়ে ব্যবসা যা-ই বলি, বাংলাদেশীদের কাছে বিষয়টি এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা বোঝা যায় পবিত্র রমজান মাসে ব্যবসায়ীদের মূল্যবৃদ্ধি ও পবিত্র কোরবানির পর পশুর চামড়া নিয়ে মূল্য কারসাজির নমুনা দেখে। কয়েকদিন আগে জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রতিবেদন হয়েছে ‘১৫৪ ট্যানারির কাছে জিম্মি চামড়া শিল্প খাত’ শিরোনামে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ‘সাভারের ১৫৪টি ট্যানারির কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে দেশের চামড়া শিল্প খাত। ...কাক্সিক্ষত দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।

তাদের আশঙ্কা, ট্যানারি মালিকরা নানা অজুহাতে সরকার নির্ধারিত দাম কার্যকর করছে না।’ প্রতিবছর এরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য খুবই ক্ষতিকর, যা অর্থনীতি ছাড়িয়ে মানুষের মূল্যবোধকে প্রশ্নের সম্মুখীন করছে, অর্থনীতির বিকাশও রুদ্ধ করে দিচ্ছে। আমরা জানি, তথাকথিত মুক্তবাজার ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সব ঠিকমতো থাকলে ভোক্তারা উপকৃত হন। বাংলাদেশে বাজার ব্যবস্থাপনা মুক্ত থাকলেও কখনোই তা ভোক্তাদের উপকারে আসে না।

তাই মুক্তবাজারের আগে ‘তথাকথিত’ শব্দটি যুক্ত করাই যায়। কেননা সরকার ক্ষেত্রবিশেষে বাজারে হস্তক্ষেপ করে, যা আবার সিন্ডিকেটের চক্রে পড়ে সিন্ডিকেট পক্ষেরই স্বার্থকে রক্ষা করে। এ অবস্থা পৃথিবীর কমবেশি সব দেশে থাকলেও বাংলাদেশের মতো এতটা উদগ্র ও বেপরোয়া নয়। 
ধর্মীয় রীতি মেনে কোরবানি করা ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা পশুর চামড়া নিয়ে খুব বেশি দরকষাকষির অবস্থানে থাকেন না, থাকতে চান না। তারপরও যখন কেউ ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে মুনাফা করে তখন বাজারে বলতে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। বাংলাদেশে প্রচুর সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্পটি তাই কোনোমতেই উঠে দাঁড়াতে পারছে না। অথচ বিকশিত চামড়া শিল্প রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তিমানুষের অর্থনৈতিক জীবনকে উপকৃত করত, সমৃদ্ধ করত।

কিন্তু প্রতিবছরই কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে সিন্ডিকেটের দাপট দেখা যায় এবং তা নতুন নতুনরূপে। যেসব ব্যক্তি কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে এই সিন্ডিকেট করেন তারাও কিন্তু ইসলাম ধর্মের মহৎ এই বিধানে সামর্থ্য অনুযায়ী অংশগ্রহণ করেন। তারা হয়তো নিজেদের কোরবানি করা পশুর চামড়াটি বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ বিধান অনুযায়ী গরিব মিসকিন, অসহায় নারী-পুরুষ, অভাবী লোকজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের মাঝে বিতরণ করেন অথবা এতিমখানা, অনাথ আশ্রম, মসজিদ-মাদ্রাসায় দান করেন।

অর্থাৎ কোরবানির পশু চামড়াটির প্রকৃত হকদার সমাজের বিশেষ একটি গোষ্ঠী, যারা কোরবানির ঈদের সময় উপার্জিত অর্থ দিয়ে উপকৃত হন। যুগ যুগ ধরে চলে আসা সামাজিক এই রীতি-নিয়ম নিয়ে কেউ কখনো বাড়তি আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়নি। কিন্তু তথাকথিত মুক্তবাজার অর্থনীতির ডামাডোলে প্রতিবছরই একটি নির্দিষ্ট সময় এলে অরুচিকর এই আলোচনা-বিতর্ক দেখা দেয়, লেখালেখি হয়। তারপর সবকিছু যথারীতি কিছু সময় পর স্তব্ধ হয়ে যায়। এভাবেই দেখছি জ্ঞানচক্ষু খোলার পর। কিন্তু এভাবে আর কত কাল চলছে?
ঈদের আগে প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. আবদুর রহমান জানিয়েছিলেন, দেশে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ কোরবানিযোগ্য পশু রয়েছে। বিক্রীত-অবিক্রীত এসব পরিসংখ্যান আমলে নিয়ে বলা যায়, এ বছর দেশে অন্তত ১ কোটি কোরবানির পশুর চামড়ার একটি বাজার সৃষ্টি হয়েছে। অথচ সবচেয়ে বেশি পশু কোরবানি হওয়া ঢাকায় আড়তদাররা বলছেন, এবার কোরবানির চামড়া কম, তাই ট্যানারদের সঙ্গে দরকষাকষি চলছে। সাভারে অবস্থিত ট্যানারিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পশুর চামড়ার সরবরাহ কম।

সব পক্ষই ঘাটতি মেটাতে রাজধানীর বাইরে নজর দিয়েছে। আবার মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, গেল কয়েক বছর ধরে সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে চামড়া সংগ্রহ করলেও তারা ট্যানারি মালিকদের কাছে লাভে বিক্রি করতে পারছেন না। আগের অভিজ্ঞতার আলোকে তাই এ বছরও পশুর চামড়ার প্রকৃত মূল্য পাওয়া নিয়ে তাদের মধ্যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে ব্যাংকগুলো বলছে, কোরবানির সময় চামড়া ব্যবসায়ীদের ঋণ দিলে অধিকাংশই ফেরত পাওয়া যায় না। খেলাপি ঋণ নবায়নে ব্যাংকগুলো একাধিকবার বিশেষ সুযোগ দিলেও তা কোনো কাজে আসে না।

পরিসংখ্যান বলছে, চামড়া খাতে বর্তমানে ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণের ৯১ শতাংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এমন অবস্থায় ব্যাংকগুলো এখন হাতেগোনা কয়েকজন ভালো উদ্যোক্তা ছাড়া আর কাউকে ঋণ দিতে চায় না। চার পক্ষের চতুর্মুখী এসব কথাবার্তায় স্পষ্টই বোঝা যায়, বিপুল পরিমাণ পশুর চামড়া দেশের বাইরে পাচার হয়ে যায়। এখন প্রশাসনের কড়াকড়িতে সড়ক ও সীমান্তে পুলিশ ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী এই বাজার নিয়ে বিশেষ সতর্ক থাকলেও পরে পরিস্থিতি শিথিল হলে কোরবানির বিপুল পরিমাণ পশুর চামড়া পাচার হয়ে যাবে। এতে কার লাভ হবে? লাভ হবে মুষ্টিমেয় বাংলাদেশের মানুষের সিন্ডিকেটের, লাভ হবে পাচার হওয়া চামড়ার গন্তব্য দেশটির কিছু মানুষ ও ভোক্তার।  
বাংলাদেশে ঈদের সময় গরু পাচার নিয়ে তেমন একটা উচ্চবাচ্য শোনা না গেলেও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সীমান্ত দিয়ে গরু পাচারচক্রে বিএসএফ কর্মকর্তারা কিভাবে ও কতটা জড়িত ছিলেন তা নিয়ে দেশটির কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো বা সিবিআইয়ের বিস্তৃত তদন্তের কথা শোনা যায়। সংস্থাটির তদন্তে বলা হয়েছে, ওই পাচারচক্রে বিএসএফের অনেক পদস্থ প্রাক্তন ও বর্তমান কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, কাস্টমস ও পুলিশের একাংশের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। গোটা চক্রটি পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ-মালদাকেন্দ্রিক হলেও কলকাতায় বিএসএফের কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও জড়িত ছিলেন বলে সিবিআই জানিয়েছে। 
পবিত্র কোরবানির ঈদকে ঘিরে অবৈধ কর্মকা-ের এই যে চক্র তা অবাধ গতিতেই চলছে, মুক্তবাজারের খপ্পরে পড়ে যা এখন অনেকটাই চিরকালীন ও স্থায়ী রূপ পেয়েছে। বাংলাদেশের অথর্নীতির সর্বৈব উন্নতি ও ভালো কামনা করা মানুষ প্রায়শই আফসোস করে বলেন, কিছু মানুষের সীমাহীন লোভ-লালসার কারণেই চামড়া শিল্পের মতো বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনাময় অনেক খাত স্বাধীনতা লাভের অর্ধশত বছর পরেও বিকশিত হতে পারছে না। আর এ কারণেই নারী শ্রমিকদের জন্য চরম বঞ্চনা ও নিগ্রহ সৃষ্টিকারী পোশাক খাত দিয়ে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় টিকে আছে। 
কোরবানির মতো মহৎ একটি ধর্মীয় উপলক্ষকে কাজে লাগিয়ে মানবসমাজের অর্থনৈতিক কর্মকা- বেগবান, নিশ্চিত ও টেকসই করার এমন সুযোগ হারাতে দেখে যে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের বাংলাদেশী মানুষের মাথা লজ্জায় কাটা যাওয়ার কথা। অর্থনীতি ও মানুষের সুন্দর ও শোভন জীবন কামনাকারী মানুষ তাই আক্ষেপ করে বলে থাকেন, বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতা কিংবা মুক্তবাজারে হাত দেওয়া যায় না এমন আবহ সৃষ্টি করে চলমান বাংলাদেশের অর্থনীতি এভাবেই চললে এক সময় রাজস্ব বিভাগের ‘রাজস্ব রাক্ষস’ মতিউরের মতো হাজারো মানুষে দেশ ভরে যাবে, যাদের সন্তানেরা সিন্ডিকেট করা অ্যাগ্রো ফার্মের নেতাদের কাছে এক বছর আগেই কোরবানির জন্য আমদানি নিষিদ্ধ গরু ১ কোটি টাকায় কেনার জন্য অগ্রিম বায়না দেবে। তারপর ওই গরুর চামড়াটি ১০ লাখ টাকায় কেনার জন্য আরেক সিন্ডিকেট নেতার সন্তান এগিয়ে আসবে। 

লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা; সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

People are also reading