হোম পিছনে ফিরে যান

স্বামী-ভাই, মামা-ভাগ্নের জোরে মালদা দুর্নীতি-বন্যায়

uttarbangasambad.com 2024/10/5
Mamata-Banerjee
সংগৃহীত ছবি

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জমি মাফিয়া, বেআইনি নির্মাণ, রাস্তা দখল নিয়ে সতীর্থদের হুমকি দেওয়ার পর বাংলার অনেক শহর পরপর মজার দৃশ্যের সাক্ষী থাকছে।

উত্তরবঙ্গে যে জেলায় শুধু দুটি লোকসভা কেন্দ্র, সেই মালদায় স্থানীয় নেতারা এখন হাসির খোরাক। সেখানে কনট্রাক্টরদের সঙ্গে নেতাদের এক কুচক্র কাজ করে। নেতাদের দৌলতেই বেআইনি নির্মাণকাজ, জমি দখল, রাস্তা দুর্নীতি বিভিন্ন জায়গায়। শহরের রাস্তা পুরো চৌপাট নেতাদের জন্য। দিদির বকুনির পর তাঁরাই এবার অনুগত চামচে, খুন্তিদের নিয়ে ঘুরছেন। লোকদেখানো নির্মাণ বন্ধ করছেন কিছু কিছু।  পছন্দের ক্যামেরাম্যানদের ডেকে ছবি তুলিয়ে পোস্ট করছেন ফেসবুকে। চামচে-খুন্তিরাও শেয়ার করছেন।

এসব আসলে ‘দিদিকে দেখাও’।

দিদি দেখুন! আমরা কত বাধ্য ছাত্র! আপনার কথা শুনে দুয়ারে দুর্নীতি সাফ করে দিচ্ছি!

দিদি দেখলেন। বা খবর পেলেন। কিছুদিন পর নেতা আবার লোকগুলোকে বসিয়ে দিলেন পুরোনো জায়গায়। দুর্নীতিপুজো আবার সব আগের মতো, ঠিক আগেরই মতো।

মালদায় আম, আমসত্ত্ব, কানসাটের চমচম, রসকদম্ব একটাও যে নির্বাচনের পর মমতার হাতে নেই, তার পিছনে জেলায় তাঁর অসীম গুণধর ভাইয়েরা। চাঁচল-হরিশ্চন্দ্রপুর থেকে বৈষ্ণবনগর-কালিয়াচক, উত্তর থেকে দক্ষিণ মালদায় সর্বত্রই দেখবেন নেতাদের ধান্দাবাজি, তোলাবাজি, অন্তর্ঘাতের গল্প। কোথাও ভালো উদাহরণ নেই তৃণমূলে। অধিকাংশই দলবদলিয়া, আদর্শহীন। বিজেপি-কংগ্রেস-সিপিএমও একই ঘোড়ার সওয়ার অবশ্য।

এবং বেআইনি কাজকর্মের শুরুতে তৃণমূলের মাথারা বিজেপি-কংগ্রেস-সিপিএম নেতাদেরও হাত ধরে নিচ্ছেন স্থানীয় পর্যায়ে। যে যেখানে একটু শক্তিশালী। কোনও প্রতিবাদে থাকেন না বিরোধীরা। যতরকম দুর্নীতি হয়, চলে। ভোটের ঠিক আগে এবার কংগ্রেসের সাংসদ দুটি শববাহী গাড়ির ব্যবস্থা করে দিলেন শহরের তৃণমূল নেতার ক্লাবে। এতদিন চোখ বন্ধ রেখে হঠাৎ সেই সময় পুর এলাকায় কাজ দিলেন এমপি ফান্ডের টাকা থেকে। কেন? অঙ্ক  স্পষ্ট। ভাই তোকে দেখলাম, তুই আমাদের নির্বাচনে দেখিস।

আক্ষরিক অর্থেই এঁরা মালদার, টাকা প্রচুর। সবচেয়ে ভয়ংকর, এঁরা বিজেপি স্টাইলেই ধর্মীয় মেরুকরণের কাজ করে যান সব প্রসঙ্গে। সাম্প্রদায়িকতার বীজ কোথায় সমূলে উপড়ে ফেলবেন, তা নয়। চাষ করেন সাম্প্রদায়িকতার।

মমতা শিলিগুড়ির জমি মাফিয়াদের নিয়ে অনেক অপ্রিয় সত্য বলেছেন প্রকাশ্যে। অযোগ্য নেতায় ভর্তি মালদার অন্তহীন কেচ্ছা অনুচ্চারিত থেকে গেল কী করে?

উত্তর মালদায় আসি প্রথমে।

ক’দিন আগে মমতা সরকারের এক মন্ত্রীকে হরিশ্চন্দ্রপুরের রশিদপুরে ক্ষিপ্ত মহিলারা তাড়া করেছিল। ভুট্টাখেত থেকে ভুট্টার গাছ তুলে সেটাকে লাঠি বানিয়ে। লোকে চাঁদ দেখতে গিয়ে প্রেমিকাকে দেখেন। মন্ত্রী বান দেখতে গিয়ে লাঠি দেখে ফিরেছেন। ফুলহর নদীতে বালির বস্তা আর বাঁশ ফেলার নামে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি হয় বলে ক্ষিপ্ত ছিল মহিলাকূল।

এই মন্ত্রীর ভাই আবার ভয়ংকর দুর্নীতিগ্রস্ত। সমস্ত অনৈতিক কাজ করে বেড়ান অক্লেশে। পঞ্চায়েত ভোটে হেরে গিয়ে বিডিওর কাছে দাবি তুলেছিলেন, তাঁকে জয়ী ঘোষণা করতে হবে।  কথা শোনেননি বিডিও। পরে দেখা গেল, সাহসী বিডিওই বদলি হয়ে গিয়েছেন। নবান্ন, কালীঘাট, ক্যামাক স্ট্রিট এসব জানে না?

 এলাকার আরও দুই বড় নেতাকে লোকে বলে মামা-ভাগ্নে। চাঁচল-খরবা থেকে রতুয়া-সামসী, সব দুর্নীতিতেই মামা-ভাগ্নের বখরা বাধ্যতামূলক। মামা-ভাগ্নেকে তোলা না দিলে কোনও কাজ হবে না। তুই দ্যাখ, আমিও দেখব। ভাগ্নের বিরুদ্ধে টাকা নিয়ে চাকরি দেওয়ার অভিযোগ পর্যন্ত আছে প্রচুর। নবান্ন, কালীঘাট, ক্যামাক স্ট্রিট এসব জানে না?

মালদার দক্ষিণে আবার মামা-ভাগ্নে বা দাদা ভাই নয়, স্বামী-স্ত্রী এবং দিদি-ভাই মহাকীর্তিমান। দুর্নীতি করে চটিয়েছেন জনতাকে।

বৈষ্ণবনগর, কালিয়াচকের দুই নেত্রীর স্বামীরা দুর্নীতির রাজপ্রাসাদে বসে এমন দাপট দেখান, যে তাঁরাই মন্ত্রী। তাঁরাই বিধায়ক। মানিকচকে আবার নেত্রীর ভাই-ই ত্রাস। ত্রিমূর্তিকে তোলা না দিলে কাজ হবে না। ওদিকে উন্নয়ন মানে যেন শুধু রাস্তা তৈরি। এবং যত রাস্তা তৈরি, তত স্বামীর পকেট ভারী। রাজারহাটের সিন্ডিকেটের  থেকেও ভয়ংকর। সব জিনিস কিনতে হবে নেত্রীর আত্মীয়র দোকান থেকে।

মমতা নিজে নারীদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সত্যিই আন্তরিক। তবে স্থানীয় নেত্রীরা যদি দুর্নীতিগ্রস্ত স্বামী বা ভাইয়ের ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে থাকেন, তা হলে নারীর ক্ষমতায়নে কী লাভ হল?

গঙ্গার ভাঙন রোখার জন্য নিয়মিত জিনিসপত্র আসে, বন্যাদুর্গতদের সাহায্যেও। অনেক টাকাই লুটপাট হয়ে যায়। ফরাক্কার একটা অংশ দক্ষিণ মালদা লোকসভার অংশ। ফরাক্কা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিশাল পরিমাণ ছাই বেরোয়। ওই ছাই নিয়েই বর্তমান ও প্রাক্তন বিধায়কের লোকেরা কোটি টাকার ব্যবসা করে। এমনিতে দুই নেতার সম্পর্ক করলার চেয়েও তেতো। ছাই এঁদের এক করে দেয়। ছাই থেকে কোটি কোটি টাকা পাই।  নেতারা ভাবেন, ওপরের লোকেরা আমার ছাই করবে! ক্যামাক স্ট্রিট, কালীঘাট, নবান্ন এসব জানে না?

এই নেতা-নেত্রীদের দুর্নীতির জন্য মালদার দুটি আসনেই মমতা-অভিষেক শূন্য পেয়েছেন। অভিষেক দলীয় সভায় সতর্ক করেছেন। লাভ হল কোথায়?

দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা-নেত্রীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পকেট ভরছেন জেলার কিছু আমলা ও পুলিশ। জমি কেলেঙ্কারির অর্ধেক দায় ভূমি ও রাজস্ব বিভাগের কিছু কর্তার। এঁদের সাহায্যেই সরকারি জমি দ্রুত বেদখল। বড় রাস্তার ধারে নয়ানজুলিগুলো পর্যন্ত রাতারাতি ভরাট হরিশ্চন্দ্রপুর থেকে কালিয়াচক। শরিকি জমিতে সামান্য পারিবারিক সমস্যা হলেই ঢুকে যাবেন পুলিশ ও নেতারা। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে যা খুশি চলছে। কালিয়াচকের বিশাল জলাভূমিতে হাত পড়ছে নেতা-ঘনিষ্ঠ মাফিয়াদের। গৌড়ের দিকে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে পুকুর বা আম বাগান। কোনও রাস্তা হয়তো চওড়া হবে, বোর্ড মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে ওই রাস্তার ধারে জমি কিনে ফেলছেন তৃণমূলের বড়, মেজো, ছোট নেতারা। নামে বা বেনামে। অবাক ব্যাপার, খবর ফাঁস হয়ে যাচ্ছে আগেই।

গত কয়েক বছরে নিঃশব্দে সামাজিক বদল হচ্ছিল কালিয়াচক, সুজাপুরের দিকে। বছর খানেক আগেও বলা হত, কালিয়াচক দেশে জাল নোট তৈরির রাজধানী। কুখ্যাত গ্যাংস্টারদের আস্তানা। সেখানেই হঠাৎ নানা  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু হয় স্থানীয় শিক্ষিতদের প্রশংসনীয় উদ্যোগে। অন্য জেলা থেকে মেয়েরা পর্যন্ত পড়তে আসছিল এখানে।  এত সুখ বোধহয় কালিয়াচকের বাসিন্দাদের সহ্য হবে না। দুই নেত্রীর স্বামীর দাপটে লোকজন বিপন্ন। কাফ সিরাপ, ব্রাউন সুগারের মতো নেশার জিনিস ফের বিক্রি শুরু হয়েছে ব্যাপক হারে। নেতা-পুলিশ যোগসাজশ না হলে এসব কী করে সম্ভব?

মালদা শহরেও একই ছবি। গোষ্ঠীবাজি চলবে। বেআইনি কাজ চলবে। দুর্নীতি চালানোর সময় সবাইকে দিয়েথুয়ে কাজ চলবে। তুইও খা, আমিও খাই, আর যেন কেউ না দেখে। যতনে হৃদয়ে রেখো তোলাবাজির কাজকারবারকে। শহরে জল জমবে, জঞ্জাল জমবে। গৌড়, আদিনা দিন-দিন ম্লান হবে পর্যটকের অভাবে। কে টানবে পর্যটক,  কে বাঁচাবে ইতিহাস? সামগ্রিক উন্নয়ন না হলেও কেউ কিছু বলবে না। এসব দুর্নীতিবাজ নেতারা কোনও সৎ নেতাকে জেলায় টিকতে দেবেন না। নানা টোপ দিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত করার চেষ্টা চালাবে।

যে মুসলিম ভোট গোটা রাজ্যে তৃণমূলের সমর্থনের অন্যতম অংশ, উত্তরবঙ্গে মালদায় তা সবচেয়ে বেশি। তা সত্ত্বেও মমতার পার্টি মালদায় বানভাসি তিনটে কারণে। এক, উত্তর থেকে দক্ষিণজুড়ে নেতাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের বল্গাহীন দুর্নীতি। কলকাতার কিছু নেতাকে এঁরা নজরানা দিয়ে চুপ রাখেন। দুই, ভোটের ম্যাচে নিজের দলকেই আত্মঘাতী গোল খাইয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা। তিন, আদি-নব তীব্র দ্বন্দ্বে চরম অন্তর্ঘাত। গৌড়-মুর্শিদাবাদে নবাবিয়ানার রক্ত লেগে, পিছন থেকে ছুরি মারামারির খেলা মালদার নেতা-নেত্রীরা ভুলতে পারেননি আজও।

এসব কি দিদি দেখবেন?

People are also reading