হোম পিছনে ফিরে যান

ক্রমেই পালটে যাচ্ছে রাজ্যপালের সংজ্ঞা

uttarbangasambad.com 3 দিন আগে

রাজ্য বনাম রাজ্যপাল ঝামেলা তুঙ্গে। মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন রাজ্যপাল, যা বিরল ঘটনা। এর শেষ কোথায়?

রাজ্যপাল নিয়ে যখনই আমি কিছু লিখি, তখনই আমার সাংবাদিক জীবনের একটি পুরোনো ঘটনা মনে পড়ে যায়।

পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল তখন বীরেন শা। লালকৃষ্ণ আদবানি দেশের উপপ্রধানমন্ত্রী। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। একদিন সকালে হঠাৎ আদবানির ফোন।

–তুমি কি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালকে নিয়ে কিছু লিখেছ? তাঁর কোন‌ও রিপোর্ট?

আমি বললাম, হ্যাঁ কয়েকদিন আগে এটা প্রকাশিত হয়েছে। রাজ্যপাল রাষ্ট্রপতি মানে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে একটি রিপোর্ট পাঠিয়েছেন। সেই গোপন রিপোর্টে তিনি জানিয়েছেন, কীভাবে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। প্রয়াত সিপিএম নেতা অনিল বিশ্বাস তখন রাজ্য সম্পাদক, তাঁর নেতৃত্বে দলীয় শিক্ষা-সেল অধ্যাপক নিয়োগ থেকে শুরু করে ছাত্রছাত্রী ভর্তি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। এসবের মধ্যে আছে রাজনীতি-দুর্নীতি ইত্যাদি ইত্যাদি।

আদবানি বললেন, ‘আমি তো তোমাকে কোনও খবর দিইনি।’

আমি বললাম, ‘না, আপনি দেননি। কিন্তু এত বড় কেন্দ্রীয় সরকার। তার মধ্যে কেউ না‌ কেউ তো আমাকে দিতেই পারে।’

আদবানি বললেন, ‘আসলে রাজ্যপালের ধারণা হয়েছে, আমিই বোধহয় তোমাকে এ খবর দিয়েছি। আসলে উনি খুব বিরক্ত।’

বীরেন শা বিরক্ত কেন? যা বুঝলাম, তাতে তাঁর বক্তব্য, ‘আমি তো রাজ্যপাল। আমি তো এইভাবে প্রকাশ্যে আমার বক্তব্য জানতে পারি না। তুমি কি চাও না যে আমি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল থাকি? রাজ্যপালের তো সাংবিধানিকভাবে হাত-পা বাঁধা। আমাকে সরকারের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সমন্বয়সাধন করে কাজ করতে হয়। আমি গোপন রিপোর্ট পাঠাতে পারি। কিন্তু সেই রিপোর্ট বাইরে চলে আসায় পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল ভাবছে, আমিই বোধহয় খবর দিয়েছি।’

আদবানি আমাকে বললেন, ‘পারলে তুমি একবার বীরেন শাকে ফোন করো। সেটাই সবচেয়ে ভালো হবে। অন্তত আমি যে তোমাকে কোনও খবর দিইনি, সেই ভুল ধারণাটা ওঁর যেন না থাকে।’

আজকের দিনে, ২০২৪-এ, রাজ্যপাল আর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভয়াবহ সংঘাতের আবহে এই ঘটনাটা মনে হয় যেন কোনও প্রাগৈতিহাসিক যুগের কাহিনী।

আসলে একটা সময় ছিল যখন রাষ্ট্রপতি এবং রাজ্যপাল সম্পর্কে আমাদের ধারণা ছিল, এই দুটি সাংবিধানিক পদ সৃষ্টি হয়েছিল ব্রিটেনের রানির আদলে। ব্রিটেনের রানি সম্পর্কে বলা হয়, তাঁকে দেখা যায়, শোনা যায় না। রাষ্ট্রপতি এবং রাজ্যপাল যথাক্রমে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের ক্যাবিনেটের সিদ্ধান্ত অনুসারে চলবেন। কিন্তু তাঁদের কোনও স্বাধীন সৃজনমূলক ভূমিকা থাকবে না। রাজ্যপাল কেন্দ্রের প্রতিনিধি। তিনি রাজ্য সরকারের সঙ্গে সমন্বয়সাধন করে চলেন। কিন্তু রাজ্যপালেরও রাজ্য সরকারের বিরোধিতা করার কথা নয়। সেটা করলে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হয়।

পশ্চিমবঙ্গে এই ধরনের সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টির নজির আছে। আমরা অতীতের যুক্তফ্রন্টের আমলে রাজ্যপাল ধরমবীরের কথা ভুলে যাইনি। কিন্তু এখন যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, বিশেষত জগদীপ ধনকর যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন, সেই ট্র্যাডিশনই চলছে আজকের রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের সময়েও। রাজ্যপাল প্রকাশ্যে রাজ্য সরকারের বিরোধিতা করছেন। তিনি কেন্দ্রকে যে রিপোর্ট দিচ্ছেন সেটা প্রকাশ করে দিচ্ছেন। তিনি সরাসরি বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে রাজনৈতিক বৈঠক করছেন। এমনকি নির্বাচনের সময়েও ‘অত্যাচারিত’ মেয়েদের হয়ে শুনানি দেবার জন্য তিনি একটা বিশেষ মঞ্চ তৈরি করেছিলেন। যেটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে শাসকদল মতামত জ্ঞাপন করেছিল।

ফলে রাজ্যপাল কেন্দ্র এবং রাজ্যের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় তো দূরের কথা, কেন্দ্রের প্রতিনিধি হিসেবে রাজ্যপাট পরিচালনার ব্যাপারে সহায়তা করা তো দূরের কথা, উলটে কেন্দ্র-রাজ্য বিরোধের একটা মস্তবড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছেন। রাজ্যের বিরোধী দল বিজেপি রাজ্যপালকে হাতিয়ার করে রাজনৈতিক সংগঠনের প্রসার এবং প্রতিপত্তি বাড়ানোর চেষ্টা করছেন।

নানা রকমের রাজ্যপাল আমি দেখেছি। পশ্চিমবঙ্গেও নুরুল হাসানকে দেখেছি। জ্যোতিবাবুর সঙ্গে তাঁর কীরকম সম্পর্ক ছিল। তারপর নুরুল হাসান রাজনীতি থেকে বেশি পছন্দ করতেন ইতিহাস এবং নানা রকম রন্ধনশিল্পের বিষয়। কিন্তু তিনি কখনও শাসকদলের সঙ্গে সংঘাতে যাননি। কিন্তু রাজীব গান্ধি যখন একবার সংঘাতে যেতে চেয়েছিলেন জ্যোতি বসুর সরকারের সঙ্গে, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সিকে প্রদেশ‌ কংগ্রেসের সভাপতি করে তখন তিনি প্রাক্তন গোয়েন্দা প্রধান টিভি রাজেশ্বরকে পাঠিয়েছিলেন। মনমোহন সিংয়ের সময় ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর নারায়ণন এসেছিলেন। তিনিও কিন্তু প্রাক্তন গোয়েন্দা প্রধান ছিলেন।

সুতরাং গোয়েন্দা প্রধানদের রাজ্যপাল হওয়ার রেওয়াজ আছে। তবে পুলিশের লোক হলেও তাঁরা কিন্তু প্রকাশ্যে রাজনীতি করেননি। তাঁরা সমালোচনামূলক রিপোর্ট দিয়েছেন রাজ্যকে। রাজ্যের বিরুদ্ধে নানা রকমের মতামত দিয়েছেন। গোয়েন্দা সূত্রে বিভিন্ন খবরাখবর রেখেছেন। কিন্তু তাঁরা প্রকাশ্য সংঘাতে যাননি। এমনকি ফাইল‌ যদি কখনও আটকে দিয়েছেন, সেটা কিন্তু বাইরে প্রচার করেননি। সেটা নিয়ে রাজ্য সরকারের মুখ্যসচিবকে ডেকে পাঠিয়ে আলোচনা করেছেন, কথা বলেছেন। জটিলতা দেখা দিলে তার নিষ্পত্তি ঘটিয়েছেন।

আবার আর এক ধরনের রাজ্যপাল হন, যাঁরা আমলা নন, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়েও প্রকাশ্য সংঘাতে গিয়ে সরকারকে টাইট দেওয়ার কাজ করেন। উত্তরপ্রদেশের রমেশ ভাণ্ডারী করেছেন। কেরলের আরিফ মহম্মদ খানও কেরল সরকারকে বেশ বেকায়দায় ফেলেছেন। তামিলনাডুতে স্ট্যালিনের বিরুদ্ধেও রাজ্যপাল আরএন রবি বেশ সক্রিয়। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর সব রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্যের যে বিরোধ সেই বিরোধগুলো একটা চরম জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে। এটা কখনোই কাম্য নয়।

আজকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক অবস্থা নিয়ে কেন্দ্রের অর্থমন্ত্রীর কাছে নেতিবাচক রিপোর্ট পাঠাচ্ছেন। চাইছেন যে কেন্দ্র এব্যাপারে হস্তক্ষেপ করুক। তাঁর রাজভবনে কেন কলকাতা পুলিশের অফিস থাকবে? কেন তার উপরে নজরদারি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলছেন। তিনি রিপোর্ট দিচ্ছেন কেন্দ্রকে এবং মুখ্যমন্ত্রীকে তিনি চিঠি দিয়ে বলছেন কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে বরখাস্ত করতে হবে। যেটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মানতে রাজি নন। আবার রাজ্যপালের ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও নানা রকম অভিযোগ তোলা হয়েছে।  রাজভবনের কোনও কর্মী রাজ্যপালের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ এনেছেন। এবং সেটা নিয়েও তৃণমূল কংগ্রেসের দিক থেকেও প্রচার হচ্ছে। রাজ্যপাল রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করছেন।

এরকম রাজ্যপাল বনাম রাজ্য সরকারের বিবাদ অতীতে দেখা গিয়েছে বলে মনে পড়ছে না। তবে সবসময় মনে হয় পশ্চিমবঙ্গের মানুষের স্বার্থে এই বিরোধ কিন্তু মীমাংসা হওয়া দরকার। পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। পশ্চিমবঙ্গের বেকার ছেলেমেয়েদের চাকরি অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। পশ্চিমবঙ্গের যে যে নাগরিক সমস্যা, সেই অস্বাচ্ছন্দ্যগুলো দূর করা বেশি জরুরি। কিন্তু রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্য সরকারের সংঘাত তৈরি কখনও অগ্রাধিকার হতে পারে না।

(লেখক সাংবাদিক)

People are also reading