হোম পিছনে ফিরে যান

অর্থনৈতিক সংকট বাড়ছে; অস্থিরতায় আরও মূল্যস্ফীতির শঙ্কা

bhorer-dak.com 2024/10/6
সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। এ মুহূর্র্তে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি সংকট, বিনিয়োগ ও ডলার সংকট মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটা নাজুক সময় পার করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে। তথ্যমতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের মোট রিজার্ভ কমে এখন ২ হাজার ৩৭৭ কোটি ডলারে (২৩.৭৭ বিলিয়ন) নেমে এসেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবপদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ এখন ১ হাজার ৮৩২ কোটি ডলার (১৮.৩২ বিলিয়ন)। তবে প্রকৃত বা ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ এখন ১৩ বিলিয়ন ডলারেরও কিছুটা কম।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সাম্প্র্রতিক সময়ে দেশের অর্থনীতি বেশ সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো মূল্যস্ফীতি। এছাড়া বৈদেশিক রিজার্ভ কমছে। ডলার সংকটে ব্যবসায়ীরা এলসি খুলতে পারছেন না। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এর মধ্যে প্রথম হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি। অর্থনীতিবিদ ড. মির্জ্জা আজিজুল আরও বলেন, জিনিসপত্রের দাম মাত্রাতিরিক্ত বেড়েই চলছে। এ অবস্থায় চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে হবে। মানুষের জীবনে যাতে স্বস্তি আসে, বিশেষ করে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান যাতে অক্ষুণ্ন থাকে এবং পুষ্টি ও খাদ্যনিরাপত্তা যাতে নিশ্চিত হয়; এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি বলেন, অর্থনীতিতে আরেক অন্যতম সমস্যা হলো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। দিন দিন এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। ফলে খেলাপি ঋণ আদায় এবং নতুন ঋণখেলাপি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

জানা যায়, গত কয়েক দিনের সহিংস ঘটনায় দেশের নিত্যপণ্যের সরবরাহব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছিল। ফলে রাজধানীর বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকে। কারফিউ দিয়ে সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ নেয়। পরে রাজধানীর সঙ্গে সারা দেশের পণ্যের সরবরাহব্যবস্থা সচল হতে শুরু করে। ফলে রাজধানীর বাজারে পণ্যের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় দামও কিছুটা কমতে শুরু করেছে। তবে এখনো দুই সপ্তাহ আগের অবস্থায় ফিরে আসেনি। এমনিতে গত দুই বছর ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে অতিষ্ঠ দেশের সাধারণ মানুষ। তার মধ্যে প্রতিদিন বাজারে গিয়ে এই চাপ আরও কড়ায়-গন্ডায় টের পাচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষ। সরকারের নানা উদ্যোগও মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে পারছে না। চাল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, চিনি, শাকসবজি, মাছ-মাংসের দাম নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার নাগালের মধ্যে থাকছে না। 

এ অবস্থায় চলমান অনিশ্চয়তা উচ্চ মূল্যস্ফীতি তথা অর্থনীতিতে নতুন করে সংকট তৈরি করেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে বিপাকে পড়েছেন গরিব মানুষ। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় গত কয়েক দিন টিসিবির কার্ডধারী এক কোটি পরিবার ভর্তুকি মূল্যে নিত্যপণ্য পাচ্ছে না। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই সরকারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা জিনিসপত্রের দাম বাড়লে কিংবা উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর সরাসরি পড়ে। তাদের সংসার চালানোর খরচ বাড়ে। এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, দুই বছর ধরে সাধারণ মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে আছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনার কারণে নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষ অস্বাভাবিক চাপে পড়েছে। এই পরিস্থিতির জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। একদিকে সবকিছু বন্ধ থাকায় নিম্ন আয়ের মানুষের কাজ নেই; অন্যদিকে বাজারে জিনিসপত্রের বাড়তি দাম। দিনমজুর শ্রেণির মানুষের দু-তিন দিনের সঞ্চয়ও থাকে না। তাই জিনিসপত্রের বাড়তি দাম উচ্চ মূল্যস্ফীতির যে নতুন সংকট চলছে; তা আরও বাড়িয়ে দিল। 

গতকয়েক দিনের সংঘাত-সংঘর্ষের কারণে বন্ধ থাকার পর গত পরশু থেকে ধীরে ধীরে রাজধানীতে নিত্যপণ্যের সরবরাহ বাড়ছে। বাজারে নিত্যপণ্যের সরবরাহ কতটা বাড়ল; তা দেখতে গতকাল বিকেলের দিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে সরেজমিন যান বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম। এ সময় তিনি বিভিন্ন দোকানে ঘুরে ঘুরে পণ্যের দাম ও সরবরাহের খোঁজ নেন। বাজার পরিদর্শন শেষে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু সাংবাদিকদের বলেন, এত ধ্বংসযজ্ঞের পরও দ্রুততম সময়ে পণ্যের সরবরাহব্যবস্থা স্বাভাবিক করা হয়েছে। পাইকারি বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি নেই। এসব পণ্য খুচরা বাজারে গেলে সেখানেও যৌক্তিকভাবে দামও কমে আসবে। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আরও জানান, বিশেষ করে কারফিউর মধ্যেও পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচের মতো পচনশীল পণ্যের সরবরাহে যেন কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকে; সে জন্য সরকার কাজ করছে। ফলে সরবরাহ নিয়ে কোনো সংকট তৈরি হবে না বলে আশা করেন তিনি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। যা অর্থবছরওয়ারি হিসাবে অন্তত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। পুরো বছরে কোনো মাসেই সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের নিচে নামেনি। অন্যদিকে জাতীয় মজুরি হার বৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ৭ শতাংশের মতো। এক বছর ধরেই খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি বেশি খারাপ অবস্থায় ছিল। গত ১২ মাসের মধ্যে ৭ মাসই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। গত বছরের আগস্ট মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে উঠেছিল; যা অর্থবছরের সর্বোচ্চ। তবে গত অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে রাখার লক্ষ্য থাকলেও এর ধারেকাছে নেই।

এ ব্যাপারে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, নিত্যপণ্যের সরবরাহ ঠিক থাকলে দামও নিয়ন্ত্রণে থাকে। কিন্তু দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি আছে; এটা তো অস্বীকার করা যাবে না। বাড়তি দাম নিয়ে সাধারণ মানুষ অস্বস্তিতে রয়েছে। ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তথা আয় বৃদ্ধির দিকে সরকারকে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। তবে গত কয়েক দিনে স্থবির হওয়া সরবরাহ শৃঙ্খল ঠিক করে দ্রুততম সময়ে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

People are also reading