হোম পিছনে ফিরে যান

আমেরিকার চোখে ভারতের নির্বাচন

uttarbangasambad.com 2024/6/2

নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটনের সংবাদমাধ্যমে ভারতের শাসকদল নানাভাবে সমালোচিত। ধর্ম নিয়ে উন্মাদনাই এর কারণ।

গ্রাফিক্স: শুভঙ্কর চৌধুরী

বনধোয়ানির জঙ্গলে জন্মদোষে শাস্তিপ্রাপ্ত শিশুটিকে কোলে নিয়ে, চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে কমলকুমার মজুমদারের ‘মতিলাল পাদরী’ বলেছিলেন, ‘আমি খ্রিস্টান নই গো বাপ’! এরকম একটা আশঙ্কার দৃশ্য আগাম আঁচ করে লেখাটা শুরু করেছেন বিশিষ্ট ভারতীয় রাজনীতি বিশেষজ্ঞ ইরফান নুরুদ্দিন।

আমেরিকার সেরা উদারপন্থী ম্যাগাজিন ‘দি নেশন’-এ ইরফান লিখছেন, ভারত এখন অধর্মের জঙ্গল। খুব শিগগির সেই অরণ্যে রোদন করতে করতে কাউকে কাউকে বলতে শোনা যাবে, আমি মুসলিম নই গো বাপ, আমি ভারতীয়! প্রসঙ্গ, গোঁড়া হিন্দুদের ভোট বাগাতে সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদি সরকারের চালু করা সিএএ। এই বৈষম্যমূলক ব্যবস্থায় ‘সুবিধাভোগী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে মুসলিম ছাড়া অন্য সব ধর্মাবলম্বীকে। অথচ ভারতের সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা আছে, ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকে নাগরিকে প্রভেদ করা চলবে না। স্বাধীন ভারতে সরকারিভাবে ‘মুসলিম গোনার কাজ’ এই প্রথম! তা গুনেটুনে হিসেবটা কত? কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য পরিসংখ্যান অনুযায়ী, খুব বাড়িয়েটারিয়ে এখন ভারতের জনসংখ্যার মাত্র পনেরো শতাংশ মুসলিম। এমন একটা সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়কে মোদিরা টার্গেট করেছেন স্রেফ সংখ্যাগুরু হিন্দু ভোট হাতানোর জন্য।

কলকাতায় ‘অধুনালুপ্ত’ মেট্রো সিনেমার গলিতে একদা হলিউডের বিভিন্ন সিনেমার স্ক্রিপ্ট বিক্রি হত। তেমনই নিউ ইয়র্কে ‘দি ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর অফিসের পাশের গলি আমেরিকান অ্যাভিনিউতে নানা দেশের ইংরেজি ম্যাগাজিন কেনাবেচা হয়। ভোটের কল্যাণে সেখানে এখন ভারতীয় ম্যাগাজিনগুলির রমরমা। সেই অঘোষিত ফরেন নিউজস্ট্যান্ডের বাঁধা খদ্দের ইরফান লিখেছেন, ভারতের এবারের লোকসভা নির্বাচন আসলে ‘পোল অফ পোলারাইজেশন’! মুসলিম বনাম হিন্দু! ঐতিহাসিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ একটি দেশে রাষ্ট্রযন্ত্রের এই সাম্প্রদায়িক প্রচার একটা আদিমতা মাত্র। পুরাণ আর কিংবদন্তির দোহাই দিয়ে যেভাবে ইতিহাস ও বিজ্ঞানকে মুছে দেওয়া হচ্ছে, তা মৌলবাদী হিন্দুত্ব ও উগ্র জাতীয়তাবাদের অভিশপ্ত ফর্ম্যাট! কিন্তু কেন? কারণ, ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ছাতিধরও এবার ভয় পেয়েছেন। ইরফান উদ্ধৃত করেছেন বার্ট্রান্ড রাসেলকে, ‘ধর্ম দাঁড়িয়ে আছে মূলত ভয়ের ওপর। রহস্যময়ের ভয়, পরাজয়ের ভয়, মৃত্যুর ভয়। ভয় নিষ্ঠুরতার উৎস’!

বস্তুত, ভারতের চলতি সংসদীয় নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন পত্রপত্রিকাগুলিতে কংগ্রেস সহ বিরোধীদের ইতিবাচকতা নিয়ে যত না আলোচনা হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে বিজেপির নেতিবাচকতা নিয়ে এবং সেক্ষেত্রে বারবার ঘুরেফিরে আসছে আরএসএস-এর ধর্মোন্মাদনার কথা। মোদির দলের ‘ডার্ক সাইড’ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে মূলত তিনটি ইস্যু। হিন্দুত্বের অ্যাজেন্ডা, বিরোধীদের কণ্ঠরোধে রাষ্ট্রযন্ত্রের দমনপীড়ন এবং নির্বিচারে পুঁজিবাদী বেসরকারিকরণ। ‘টাইম’ ম্যাগাজিনে হালে প্রকাশিত হয়েছে ভারতের সেন্টার ফর দি স্টাডি অফ ডেভেলপিং সোসাইটিজ-এর লোকনীতি সার্ভের ফলাফল। তাতে দেখা যাচ্ছে যে, প্রত্যাবর্তন মোটেই সহজ হবে না মোদির পক্ষে।

সংশ্লিষ্ট নিবন্ধে আস্থা রাজবংশী লিখেছেন, একচেটিয়া ক্ষমতা নিশ্চিত করতে বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকারের নানা সংস্থা ও অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগিয়ে কথায় কথায় বিরোধী নেতা আর সাংবাদিকদের জেলে পোরার কৌশল নিয়েছে। এমনকি ঘটেছে সাংবাদিক হত্যার ঘটনাও এবং আশ্চর্য, বদ উদ্দেশ্যপূরণের জন্য অনেকক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান ও উচ্চ বিচারব্যবস্থাকেও কাজে লাগানো হচ্ছে। কাজেই মানবাধিকার এবং বাচন স্বাধীনতা হরণের ক্ষেত্রে মোদি এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এই লেখায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির গলাগলির কারণ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, কেন তাঁরা পরস্পরকে ‘গুড হিউমার’-এ রাখার চেষ্টা করছেন!

এর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছে আমেরিকার অন্যতম সেরা ট্যাবলয়েড ‘উইকলি ওয়ার্ল্ড নিউজ’। ওই সংবাদপত্রে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশেষজ্ঞ জ্যারেড কোহেন লিখেছেন, আগামী নভেম্বরে আমেরিকায়ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। কাজেই বৈদেশিক কূটনীতির প্রশ্নে এশিয়ার ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ করার ক্ষেত্রে ভারতের চলতি ভোটের ফলাফল মার্কিন প্রশাসনের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওই মহাদেশে চিনকে ঠেকাতে হলে আমেরিকার ভারতকে দরকার, কারণ পাকিস্তান ও বাংলাদেশের হকিকত এখন খুব ঘোলাটে। ধর্ম বা বর্ণ, ভিত্তি যা-ই হোক না কেন, সংকীর্ণ বিদ্বেষ মানসিকতার কারণে ট্রাম্প ও মোদি পরস্পরের ‘অটোমেটিক চয়েস’। অন্যদিকে, হারজিত যা-ই হোক না কেন, পররাষ্ট্র রাজনীতির কারণে মোদিকে তোয়াজ করে চলতে হবে বাইডেনকেও। অথচ তাত্ত্বিক নীতিআদর্শের প্রশ্নে ‘উদার’ বাইডেন আর ‘রক্ষণশীল’ মোদির মিলমিশ হওয়ার কথাই নয়!

প্রসঙ্গত চলে আসবে সাবরিনা সিদ্দিকীর কথা। গত বছর হোয়াইট হাউসে বাইডেনের সামনেই উনি মোদিকে প্রশ্ন করেছিলেন যে, ভারতে কেন মন্দির দিয়ে উন্নয়ন মাপা হচ্ছে? কেন ইতিহাসকে উপেক্ষা করে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা হচ্ছে? কেন যাবতীয় বিজ্ঞানকে ভারতীয় পুরাণের কল্পবিজ্ঞান বলে চালানো হচ্ছে? সেই সাবরিনা ‘দি ওয়াশিংটন পোস্ট’-এ মোদির নাম দিয়েছেন ‘ফ্যাসিস্ট ফকির’। সাবরিনার সওয়াল, কোটি কোটি টাকার মালিক মোদি কীভাবে নিজেকে ফকির বলেন। একজন প্রধানমন্ত্রী হয়েও কীভাবে তিনি চেপে যান যে, তিনি বিবাহিত এবং তিনি একটি বাড়ির মালিক। অথচ গুজরাটে তাঁর স্ত্রী এবং মোদির ব্যক্তিগত বাসভবনের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়েছে সরকারি খরচে!

‘দি নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এ বিজেপির বিরোধিতায় রাহুল গান্ধির ‘ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা’র প্রশংসা করেছেন ভারত বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক আনন্দ গিরিধরদাস। তিনি লিখছেন, কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে সমগ্র দক্ষিণ ভারতে ‘মোদি হটাও’ হাওয়া তুলে দেওয়ায় বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ বেশ শক্তপোক্ত হয়েছে। তিনি পাশে পেয়েছেন আপ এবং তৃণমূল কংগ্রেসের মতো সফল আঞ্চলিক দলগুলিকে। পশ্চিমবঙ্গের সামাজিকমাধ্যম উদ্ভূত স্লোগান ‘নো ভোট টু বিজেপি’ দেশের নকশালপন্থী দলগুলিকেও কাছে টেনে নিয়েছে। পক্ষান্তরে মোদি যা করছেন, তার সবটাই আরএসএস মোহন ভাগবতের অমোঘ নির্দেশে। তিনি যোগ্য শাগরেদ হিসেবে পেয়েছেন নিজের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শা এবং উত্তরপ্রদেশ ও অসমের দুই মুখ্যমন্ত্রীকে। সেখানে লেখা হয়েছে, বিজেপির অভ্যন্তরের খবর হল, এবার জিতলে মোদিকে সরিয়ে প্রধানমন্ত্রী করা হতে পারে অমিতকেই।

ভারতের নির্বাচনি আবহাওয়ার সেরা স্থিরচিত্রটি ছাপিয়েছে আমেরিকার বহুল প্রচারিত সাময়িকপত্র ‘পিপল’। ওই ম্যাগাজিনে একটা নিয়মিত পাতা থাকে, শিরোনাম ‘ওয়াচ দ্য ওয়ার্ল্ড’। সেখানে বিশ্বের কোনও উল্লেখযোগ্য বিষয় বা ঘটনার ছবি প্রকাশিত হয়। ওদের সাম্প্রতিক সংখ্যার ছবিটি হল ‘ইন্দো-মার্কিন’ গোছের। আলিঙ্গনবদ্ধ ট্রাম্প ও মোদি, ওয়াশিংটন ডিসি, ২০১৭। ওরা ছবিটার নাম দিয়েছে ‘রেস অ্যান্ড রিলিজন’! সত্যিই তো, রেস রেস করতে করতে রাজনৈতিক রেসুড়ে হয়ে উঠেছেন ট্রাম্প। ঠিক তেমনই ধর্ম ধর্ম করে এমন খেপে উঠেছেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি যে, অধর্মের কল বাতাসে নড়তে শুরু করেছে।

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘সীতারাম’ উপন্যাসের সেই সংলাপটা মনে পড়বেই। হিন্দু রাজা সীতারামকে ফকির চাঁদশাহ বলেছিলেন, ‘তুমি যদি হিন্দু মুসলমান সমান না দেখো, তবে এই হিন্দু মুসলমানের দেশে তুমি রাজ্য রক্ষা করিতে পারিবে না। তোমার রাজ্যও ধর্মরাজ্য না হইয়া পাপের রাজ্য হইবে’।

(লেখক আমেরিকার ন্যাশভিলের বাসিন্দা। প্রবন্ধকার)

People are also reading