হোম পিছনে ফিরে যান

মুঠোফোন দুর্ভোগ: কলড্রপে বাড়ছে খরচ ও ভোগান্তি

bhorer-dak.com 5 দিন আগে
কলড্রপ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক সমস্যায় সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন মুঠোফোন গ্রাহকরা। মুঠোফোনের কলড্রপ বিড়ম্বনা দিন দিন বাড়ছে। কথা বলার সময় একাধিকবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। কখনো কখনো সংযোগ চালু থাকলেও শোনা যায় না অপর প্রান্তের কথা। মাত্রাছাড়া এই কলড্রপ মুঠোফোন গ্রাহকদের ভোগান্তির পাশাপাশি বাড়াচ্ছে কথা বলার খরচও। ভোগান্তির পাশাপাশি গ্রাহকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। গ্রাহকদের অভিযোগ, গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার সময় সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। কলড্রপ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক সমস্যায় সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন মুঠোফোন গ্রাহকরা। সমস্যাটি দীর্ঘদিনের হলেও সাম্প্রতিক সময়ে ভোগান্তি অনেকাংশে বেড়েছে। কথা বলার সময় ঘন ঘন কলড্রপ নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে অতীতে জাতীয় সংসদেও একাধিকবার কথা উঠেছে। কিন্তু কলড্রপ থামছে না। কলড্রপ বন্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই নিয়ন্ত্রক সংস্থার।

টেলিকম খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপারেটরগুলোর নেটওয়ার্ক সক্ষমতার চেয়ে গ্রাহক সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে কলড্রপ বাড়ছে। এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকেও দুষছেন তারা। তবে মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো বলছে, অবৈধ জ্যামার কিংবা রিপিটারের কারণে তাদের সেবার মান ব্যাহত হচ্ছে। আর বিটিআরসির দাবি, গ্রাহক ভোগান্তি কমাতে এবং সেবার মান বাড়াতে সব ধরনের সহযোগিতা তারা অপারেটরগুলোকে দিচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে প্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহা বলেন, মানহীন নেটওয়ার্কের দুটি কারণ, একটি হলো- গ্রাহকদের সংখ্যার বিষয়ে দূরদর্শিতা ও যথাযথ সমীক্ষার অভাব। গ্রামীণফোন, বাংলালিংক ও রবি বিভিন্ন সময় চটকদার অফার ও ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস ছাড়ছে। এগুলো ছাড়ার ক্ষেত্রে তাদের দূরদর্শিতা নেই। 

বিটিআরসির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত এক বছরে চারটি মোবাইল অপারেটরের ১১ কোটি ৬৫ লাখ ৭৮ হাজার ১৮৬ বার কলড্রপ হয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬ কোটি ৮২ লাখ ৬৩ হাজার ২৮৬ বার কলড্রপ হয় গ্রামীণফোনের। বাকি অপারেটরগুলোর মধ্যে রবি আজিয়াটার ২ কোটি ৮৮ লাখ ৪৮ হাজার ৬৯৬, বাংলালিংকের ১ কোটি ৯৫ লাখ ৭১ হাজার ৬৭৩ এবং টেলিটকে ৪ লাখ ৯৭ হাজার ৬০১ বার কলড্রপ হয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিনটি অপারেটরের কলড্রপ আগের বছরের তুলনায় কমলেও গ্রামীণফোনের বেড়েছে প্রায় ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ। তবে মোবাইল নেটওয়ার্ক কোম্পানি গ্রামীণফোনের দাবি, তাদের কলড্রপের হার দশমিক ৩ শতাংশ; যা বিটিআরসি কর্তৃক নির্ধারিত (২ শতাংশ) সীমা থেকে অনেক কম।

এ বিষয়ে মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দীন আহমেদ অভিযোগ করে বলেন, কলড্রপ নিয়ে গ্রাহকদের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। কলড্রপের ক্ষতিপূরণও আমরা ঠিকঠাক পাই না। এখন অপারেটরগুলোর উচিত কোয়ালিটি সার্ভিস নিশ্চিত করা। পাশাপাশি বিটিআরসিকেও নতুনভাবে ড্রাইভ টেস্টের মাধ্যমে কলড্রপের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে হবে। টেলিকম খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কলড্রপের ক্ষতিপূরণ হিসেবে বিশ সেকেন্ড ফেরত দেয়ার চেয়েও গ্রাহকের কলটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল; অপারেটরদের সেটি আগে ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে কারিগরি ত্রুটির কারণে কলড্রপ হয়ে থাকলে; তা গ্রাহকদের আগেই অবগত করার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।

বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, গ্রামীণফোনের মোট গ্রাহক ১০ কোটি ২০ লাখ। বরাদ্দ করা তরঙ্গ ৪৭ দশমিক ৪ মেগাহার্জ, প্রতি মেগাহার্জে গ্রাহক ১৭ লাখ ৩০ হাজার। রবির গ্রাহক সংখ্যা ৬ কোটি ১৮ লাখ, বরাদ্দ করা তরঙ্গ ৪৪ দশমিক শূন্য মেগাহার্জ, প্রতি মেগাহার্জে গ্রাহক ১১ লাখ ৮০ হাজার। বাংলালিংকের গ্রাহক ৪ কোটি ৬৫ লাখ, বরাদ্দ করা তরঙ্গ ৪০ দশমিক শূন্য মেগাহার্জ, প্রতি মেগাহার্জে গ্রাহক ৯ লাখ ১০ হাজার। টেলিটকের গ্রাহক সংখ্যা ৯০ লাখ, বরাদ্দ করা তরঙ্গ ২৫ দশমিক ২ মেগাহার্জ। প্রতি মেগাহার্জে গ্রাহক ২ লাখ ৪০ হাজার। বিটিআরসির তথ্য মতে, দেশে মোবাইল ফোনের গ্রাহক ১৮ কোটি ৬৩ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ১২ কোটি গ্রাহক মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। বিপুলসংখ্যক গ্রাহক সত্ত্বেও মোবাইল অপারেটরগুলো যথাযথভাবে সেবার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। দেশে মোবাইল ফোন অপারেটরের সংখ্যা তুলনামূলক কম বলে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও সে অর্থে কম। তা সত্ত্বেও গ্রাহককে নিয়মিতই নানা ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।

রাজধানীর মিরপুরের পীরেরবাগের বাসিন্দা মিলন মাহমুদ বলেন, আমি জিপি ও এয়ারটেল সিম ব্যবহার করি। বাসায় ঢুকলে কোনো সিমে নেট থাকে না। কথা বলার সময় লাইন কেটে যায়, অস্পষ্ট কথা, বারবার হ্যালো হ্যালো বলেও কথা বোঝা যায় না। এটা চরম বিরক্তিকর। আবার অনেকেই অভিযোগ করে, আমার ফোন নাকি বন্ধ থাকে। কীভাবে বোঝাব, ঢাকায়ও নেটওয়ার্ক সমস্যা হয়। কলামিস্ট লীনা পারভীন বলেন, আমি জিপি সিম ব্যবহার করি। প্রতিনিয়ত নেটওয়ার্ক ঝামেলা হচ্ছে। দরকারি কথা বলার সময় হঠাৎ কথা কেটে যায়; আবার মাঝেমধ্যেই কলড্রপ হয়। এতে ভুল বোঝাবুঝিরও সৃষ্টি হয়। কলড্রপ যে শুধু আমার দিক থেকে হয় তা কিন্তু নয়; অপরপ্রান্ত থেকেও হয়। হয়তো আমি ভাবছি, অন্য প্রান্ত থেকে আমার কল কেটে দিল কি না। এমন বিব্রতকর পরিস্থিতি ইদানীং বেশি হচ্ছে। গ্রাহক হিসেবে আমি অত্যন্ত বিরক্ত এবং এই দায় মোবাইল কোম্পানিগুলোকেই নিতে হবে।

এ বিষয়ে মোবাইল নেটওয়ার্ক কোম্পানি রবির সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মাহমুদুর রহমান বলেন, গ্রাহকরা তো সব সময় কলড্রপের হিসাব করে না। সুতরাং মাঝেমধ্যে তারা ক্ষতিপূরণ পেলেও তার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তা ছাড়া কলটি আমার জন্য কতটা জরুরি ছিল; তার মূল্যায়ন কি ওই ফেরত পাওয়া বিশ সেকেন্ড দিয়ে হবে? যেখানে একটি প্রযুক্তির ওপর তারা আমাদের নির্ভরতা বাড়িয়েছে; সুতরাং এ বিষয়ে দায়িত্বও তাদের নিতে হবে। কলড্রপ যদি কারিগরি ত্রুটির কারণে হয়ে থাকে; তা হলে গ্রাহকদের সেটা আগেভাগে জানানোর সুযোগ আছে। এ বিষয়ে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট শামসুল আলম বলেন, মোবাইল অপারেটর কোম্পানির বিরুদ্ধে হাজার হাজার অভিযোগ জাতীয় ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষণ অধিদপ্তরে জমা হয়ে আছে। কিন্তু তারা মামলা সংক্রান্ত কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না।

তবে বিটিআরসির দাবি, তারা গ্রাহকদের ভোগান্তি কমাতে সব ধরনের সহযোগিতা করছে মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোকে। এ বিষয়ে বিটিআরসি কমিশনার প্রকৌশলী শেখ রিয়াজ আহমেদ বলেন, বিটিআরসির কাজ মোবাইল অপারেটরদের প্রয়োজনীয়তা ভেদে সহযোগিতা করা এবং গ্রাহকের ভোগান্তি কমাতে পদক্ষেপ নেয়া। প্রত্যেক অপারেটরকেই পর্যাপ্ত স্পেকট্রাম দেয়া হয়েছে। এর পরও আমরা তাদের কলড্রপসহ আরও যেসব অভিযোগ রয়েছে; সেসব বিষয়ে নিয়মিত তাগাদা দিয়ে যাচ্ছি। 

প্রকৌশলী রিয়াজ আরও জানান, বিটিআরসির জনবল সংকট রয়েছে। যার ফলে তাদের পক্ষে আঠারো কোটি মানুষের চাহিদা অনুযায়ী মনিটরিং সম্ভব হচ্ছে না। আমরা চেষ্টা করছি জনবল বাড়ানোর। এছাড়া যুগের সঙ্গে মানুষের চাহিদাও বেড়েছে। এক সময় মাত্র চার কোটি মোবাইল গ্রাহক থাকলেও এখন সেই সংখ্যা আঠারো কোটির বেশি। তাই আমরা যখনই অপারেটরদের সঙ্গে বসি সেখানে গ্রাহকদের চাহিদা সবার আগে গুরুত্ব পায়।

People are also reading