হোম পিছনে ফিরে যান

বারাণসীতে ব্যবধান বাড়ানোর লড়াই প্রধানমন্ত্রীর, রয়েছে কাঁটাও

sangbadpratidin.in 2024/5/19

কাশী ধামে এখন যেমন 'হর হর মহাদেব' রব শোনা যায়, তেমনি শোনা 'যায় হর হর মোদি' রবও।

অনুরাগ রায়, বারাণসী: রঙিন সংকীর্ণ অলি-গলি, বেনারসী পান, একের পর এক গঙ্গার ঘাট, সন্ধের আরতী আর কাশী বিশ্বনাথ। বারাণসী বললে এসবই ভেসে ওঠে চোখের সামনে। তবে এখন যাঁরা প্রাচীন এই শহরের ইতিহাস খুঁজতে আসবেন, তাঁরা একদিকে যেমন নস্ট্যালজিয়ায় ডুব দিতে পারবেন, তেমনই পাবেন আধুনিকতার স্পর্শও। ঘাটের ধারগুলোতে আবর্জনা নেই। চওড়া রাজপথ, ঝকঝকে আলো, ঝাঁ চকচকে ইমারত, শপিং মল, আধুনিকতায় মোড়া ইমারত, কাশী বিশ্বনাথ করিডরের দিকে তাকাতে তাকাতে একটা সময় মনে হতে পারে, কোনও অত্যাধুনিক মেগা সিটিতে পৌঁছে গিয়েছেন। বস্তুত কাশী বিশ্বনাথ করিডরের মতোই গত ১০ বছরে চওড়া হয়েছে বারাণসীর কপাল। কাশী ধামে এখন যেমন ‘হর হর মহাদেব’ রব শোনা যায়, তেমনি শোনা ‘যায় হর হর মোদি’ রবও।

Lok Sabha 2024: Ground report from Ground Zero
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.

বছর দশেক আগে জাতীয় রাজনীতিতে ধুমকেতুর মতো উত্থান হয় মোদির (Narendra Modi)। উত্তরপ্রদেশের ৮০ আসন টার্গেট করে ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’ মোদি নিজের রাজ্য ছেড়ে বারাণসীতে লড়তে আসেন। স্বপ্ন দেখান বারাণসীই প্রধানমন্ত্রী দেবে দেশকে। বদলে যাবে কাশীথানের আদল। বিদ্যুতের জন্য কষ্ট পেতে হবে। দূর হবে তাঁতশিল্পীদের দুর্দশা। মোদির দেখানো সেই স্বপ্নে বিভোর হয়ে ২০১৪ সালে কাশীবাসী দুহাত ভরে আশীর্বাদ করেন গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীকে। ভোটের পর আহমেদাবাদ ছেড়ে মোদি দিল্লির মসনদে বসার পর সত্যি সত্যিই বদলে গিয়েছে বারাণসীর ভাগ্য। প্রধানমন্ত্রীর নিজের লোকসভা কেন্দ্রের যে জৌলুস থাকা উচিত, সে জৌলুস অন্তত বারাণসী শহরের প্রতিটি কোণায় স্পষ্ট। সনাতনী ঐতিহ্য ধরে রেখে আধুনিকতার মোড়কে মুড়ে গিয়েছে গোটা শহর। এখানে এলে সমস্ত আধুনিক সুযোগ-সুবিধা যেমন জুটবে, তেমনি খুঁজলে ঐতিহ্যের আমেজও পাওয়া যাবে।

Lok Sabha 2024: Ground report from Ground Zero

বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের দিকের রাস্তাটা অনেকটাই চওড়া। কিছুদূর গেলেই নজরে পড়বে ‘পেহেলবান লস্যি’। যাঁরা বারাণসীতে (Varanasi) এসেছেন, তাঁদের জন্য অতি পরিচিত নাম। এখানকার নানা সুস্বাদু চাট, বারড়ি, প্যাঁড়া যেমন বিখ্যাত তেমনি নাম রয়েছে এই পেহেলবান লস্যিরও। মুরলী মনোহর যোশী থেকে শুরু করে, অখিলেশ যাদব, রাহুল গান্ধী (Rahul Gandhi), হেন কোনও নেতা নেই যাঁরা এই দোকানে পা রাখেননি। সকাল থেকে সন্ধে সমানে ভিড় লেগে থাকে। দোকানের পাশে জনাকয়েক স্থানীয় যুবক খোশগল্পে মেতেছিলেন। তবে রাজনীতির উত্তাপ বিশেষ পাওয়া গেল না। ভোটের কথা পাড়তেই ওদিক থেকে সটান জবাব দিল, “ইয়হা স্রিফ মোদিজি কি চলেগা।’ পাশ থেকে আরেক যুবক বললেন, “মোদিজির রাজত্বে সব পেয়েছে বারাণসী। আগের থেকে ব্যবধান বাড়বে প্রধানমন্ত্রীর।” আরও দুচার জনের সঙ্গে কথা বলে যা বোঝা গেল, হারা জেতাটা ফ্যাক্টর নয়। প্রধানমন্ত্রীর জয়ের ব্যবধান কত হবে, সেটাই যেন মূল বিচার্য।

Lok Sabha 2024: Ground report from Ground Zero

২০১৪ সালে এই বারাণসী থেকে মোদি জিতেছিলেন ৩ লক্ষ ৭১ হাজারের কিছু বেশি ভোটে। সেবারে মোদির প্রাপ্ত ভোট ছিল ৫৬ শতাংশের কিছু বেশি। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রার্থী ছিলেন আপ সুপ্রিমো অরবিন্দ কেজরিওয়াল (Arvind Kejriwal)। লাখ দুয়েকের কিছু বেশি ভোট পান কেজরি। কংগ্রেসের অজয় রাই ৭৫ হাজার ভোট পেয়ে তৃতীয় হন। ২০১৯-এ প্রধানমন্ত্রীর ভোট অনেকটাই বাড়ে। সেবার ৬ লক্ষ ৭৪ হাজারের বেশি ভোট পান মোদি। শতাংশের বিচারে সেটা ৬৩ শতাংশের কিছু বেশি। এবারে দ্বিতীয় হন সমাজবাদী পার্টির শালিনি যাদব। তিনিও লাখ দুয়েকের কাছাকাছি ভোট পান। কংগ্রেসের অজয় রাই উনিশেও তৃতীয় হন। তবে এবারে দ্বিগুণেরও বেশি হয় ভোট বাড়ে তাঁর। এই অজয় রাই-ই এবার মোদির মূল প্রতিপক্ষ। কারণ বারাণসীতে কংগ্রেসকে (Congress) সমর্থন করছে সমাজবাদী পার্টি।

Lok Sabha 2024: Ground report from Ground Zero

বারাণসীতে যে পাঁচটি বিধানসভা কেন্দ্র আছে, তার মধ্যে চারটি বিজেপির দখলে। একটা জোটসঙ্গী আপনা দলের দখলে। ২০১৯ লোকসভার তুলনায় বাইশের বিধানসভায় ভোট কমেছে বিজেপির। সেবারে ৪২.২ শতাংশ ভোট পায় গেরুয়া শিবির। কংগ্রেস এবং সমাজবাদী পার্টির মিলিত ভোট প্রায় ৩৩ শতাংশ। কোনও অঙ্কেই বিজেপির ধারেকাছে আসছে না জোট শিবির। তবে জোট শিবিরের হয়ে লড়াইয়ের ব্যাটন যাঁর হাতে, সেই অজয় রাই আশাবাদী। তিনি বলছেন, ‘এবার একপেশে লড়াই হবে না। মোদিকে হারাতে পূর্ণ শক্তিতে লড়ব আমরা।’ তাঁর অনুগামী যে দুটো-চারটে পাওয়া গেল না তাও নয়। তাঁরা বলছেন, প্রদীপের আলোর নিচে যেমন অন্ধকার থাকে, বারাণসীতেও তেমনি অন্ধকার আছে। এখানকার মূল সমস্যা বেকারত্ব। স্থানীয় এক কংগ্রেস নেতা বলছিলেন, “বলুন তো ১০ বছরে মোদি কটা কারখানা গড়েছেন এখানে। বেকার ছেলেমেয়েদের হাতে কাজ নেই। কেউ গাইড হয়ে, কেউ ছোট দোকান দিয়ে কোনও মতে দিন গুজরান করে।” কংগ্রেসের আশা, এবার যেহেতু সমাজবাদী পার্টি আর কংগ্রেসের জোট হয়েছে, তাই লড়াইটা কঠিন হবে। তাছাড়া অজয় রাইয়ের পক্ষে জাতিগত সমীকরণও কাজ করতে পারে।

বারাণসীর মোট ভোটারের ১৪ শতাংশের কিছু ভোটার মুসলিম সম্প্রদায়ের। দলিতের সংখ্যাটাও প্রায় ১৩ শতাংশ। অজয় রাই যে ভূমিহার সম্প্রদায়ের, সেই ভূমিহারদের ভালো প্রভাব রয়েছে বারাণসী-সহ গোটা পূর্বাঞ্চলে। সেই সঙ্গে কিছুটা যাদব ভোট, যৎকিঞ্চিত বাঙালি ভোটার রয়েছেন, সব যোগ করলে ভালো টক্কর দেওয়ার মতো জায়গায় আছেন অজয় রাই। মোদির ভোটের ব্যবধান বাড়তে পারে, সেটা কোনও মতেই মানতে নারাজ বিরোধী শিবির। বোঝা গেল বেশ অঙ্ক কষেই মোদিকে প্যাঁচে ফেলার ছক করা হয়েছে। কিন্তু খাতায় কলমে যে অঙ্ক কষা হয়েছে, বাস্তবের মাটিতে সেটা মিলবে তো?

মুসলিম পল্লিতে ঢুঁ মেরে বোঝা গেল, উন্নয়নের আঁচ সেখানে যে পৌঁছায়নি, সেটা নয়। কিন্তু সমান অসন্তোষও রয়েছে। স্থানীয় এক মুসলিম যুবক বলছিলেন, “তাঁতিদের জন্য কিছুই করেননি মোদি। ১০ বছর আগে আমাদের যা অবস্থা ছিল, তার চেয়ে আরও খারাপ পরিস্থিতি।” তাঁতিদের দুর্দশার কথা আরও দু-একজনের মুখে শোনা গেল। জিএসটি চালু হয়েছে, সুতোর দাম বেড়েছে। কিন্তু বেনারসী শাড়ির কদর বিশেষ বাড়েনি। ফলে চরম সমস্যায় পড়ছেন তাঁতিরা। যাঁদের অধিকাংশই মুসলিম। তবে মুসলিমদের মধ্যে অসন্তোষকেও ছাপিয়ে গিয়ে চাপা ক্ষোভ রয়েছে। যেভাবে ‘জ্ঞানবাপী’ নিয়ে জলঘোলা হচ্ছে, সেটা সংখ্যালঘু সমাজের সিংহভাগ মানুষই মানতে পারছেন না। প্রকাশ্যে না বললেও হাবেভাবে তা বোঝা যাচ্ছে। তবে ক্ষোভ-অসন্তোষের মধ্যে দু-একজন সংখ্যালঘু যুবক যে প্রধানমন্ত্রীর কাজের প্রশংসা করেননি, তাও নয়। তাঁদের বক্তব্য, “রাস্তাঘাট ঝকঝক করছে। ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাই। রেশন পাই। মোদিজি তো সবই করেছেন।” তবে সংখ্যালঘুদের মধ্যে মোদির প্রশংসকের থেকে নিন্দুকই বেশি পাওয়া গেল। ফিরতে ফিরতে অবশ্য এক চাচার কথা কানে ভাসছিল। তিনি বলছিলেন, “ধান্দা থপ হ্যায়। হামারা শুননেওয়ালা ভি কোয়ি নেহি। লেকিন কিয়া করে, আয়েগা তো মোদি হি। কিসি ওউর কো দেকে ভোট বরবাদ কিউ করে।” বোঝা গেল, ‘আয়েগা তো মোদি হি’- এই মন্ত্র বারাণসীতেও মুসলমানদের মধ্যে গেঁথে ফেলেছে বিজেপি। যার সুফল কিছুটা হলেও পাবেন প্রধানমন্ত্রী। সংখ্যালঘুদের একটা অংশও এবার তাঁকে সমর্থন করবেন। তাছাড়া সংখ্যালঘু ভোট কংগ্রেস একাই পাবে, ভাবার কোনও কারণ নেই। কারণ এখানে বিএসপি আবার প্রার্থী করেছে সৈয়দ নেয়াজ আলির মতো প্রভাবশালী নেতাকে। শেষমুহূর্তে লড়াইয়ে নামতে পারে আসাদউদ্দিন ওয়েইসির AIMIM-ও।

বারাণসীতে আগের তুলনায় কমেছে বাঙালির সংখ্যা। আসলে মোদির ‘উন্নয়নের ধাক্কা’য় কাজ হারিয়ে শহর ছেড়েছেন অনেকেই। স্থানীয় হিন্দিভাষীদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছেন না প্রবাসীরা। বিশেষ করে আমিষ খাবার নিয়ে কড়াকড়ি হওয়ায় রোজগারহারার সংখ্যা বাড়ছে। সেই অসন্তোষের আঁচ এবার ভোটবাক্সে পড়তে পারে। আরেকটা কথা বলা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এবার প্রার্থী হয়েছেন কিন্নর সমাজের প্রতিনিধি মহামণ্ডলেশ্বর হিমাঙ্গী সখী। তিনি নিজেকে ‘অর্ধনারীশ্বর’ বলে পরিচয় দেন। স্থানীয়দের অনেকেই তাঁকে সম্মান করেন। তিনি কিছু ভোট কাটলে ক্ষতি হবে প্রধানমন্ত্রীরই।

বিকেলের পর থেকে গঙ্গার পাড়ে ভিড় বাড়তে থাকে। পর্যটকরা যেমন আসেন, তেমনি স্থানীয়রাও ভিড় জমান ‘গঙ্গা মাইয়া’র শীতল বাতাসে উপভোগ করতে। আরতী দেখতে। গঙ্গার ধারেই জনা কয়েক যুবকের জটলা দেখা গেল। মনে হল, বেকারত্ব সত্যিই সমস্যা কিনা, সেটা বুঝে নেওয়ার মোক্ষম জায়গা এটাই। কাম-কাজ কেমন? প্রশ্ন শুনে এক যুবক বলে উঠলেন, “রোজ এখানে ৩ লক্ষ পর্যটক আসে। একটু বুদ্ধি করে চললে ধান্দা মন্দ হয় না।” আরেকজন আবার বললেন, ‘এসব বিরোধীদের অপপ্রচার। এবার মোদিজি ৮ লক্ষ ভোট পাবেন।” ঘাটের ধারে সাধু-সন্তদের মুখেও শোনা গেল মোদি-মোদি রব। সদ্য গঙ্গামাইয়ার বুক থেকে আরতী করে ফিরছিলেন এক ব্রাহ্মণ। তিনি বলে উঠলেন, “মোদিজি নে যেয়সে গঙ্গা মাইয়াকো কিচড় সে মুক্ত কিয়া, ওয়াইসে হি বিরোধীও কো ভি সাফ কর দেঙ্গে।” শুনতে শুনতে সত্যিই মনে হচ্ছিল, বারাণসীর পরিচ্ছন্ন গঙ্গার মতোই মোদির জয়ের রাস্তাও পরিষ্কার। কিন্তু গঙ্গা মাইয়াও তো এখনও পুরোপুরি ‘কিচড়’ মুক্ত হননি।

People are also reading